৯ বছরে ১১০০০ কোটি টাকার প্রকল্প- তবুও ডুবছে চট্টগ্রাম
প্রকাশ: রোববার, ৬ আগস্ট, ২০২৩, ৬:২৬ অপরাহ্ন সর্বশেষ আপডেট: রোববার, ৬ আগস্ট, ২০২৩, ৬:২৯ অপরাহ্ন
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে চারটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে শুরু হওয়া এসব প্রকল্পে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা।
বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের জল-ভোগান্তি দূর করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। উল্টো দিন দিন বেড়েই চলেছে ভোগান্তি।
এর কারণ হিসেবে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আলাদা আলাদা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
উদ্দেশ্য একই হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এ তিন সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। প্রকাশ্যে একটি সংস্থা অন্যটিকে দোষারোপ করছে আর যে যার মতো করে কাজ করছে।
এদিকে নগরের নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বহু নালায় জমেছে ময়লা ও পলিথিনের স্তূপ। নালা পরিষ্কারের দায়িত্ব কার, সেটা নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে চসিক-সিডিএর মধ্যে।
সিটি করপোরেশন বলছে, নালা পরিষ্কার তাদের নিয়মিত কাজ হলেও বর্তমানে এগুলো সিডিএর প্রকল্পের অধীনে রয়েছে। যেহেতু এখানে তারা (সিডিএ) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তাই নালা পরিষ্কারের দায়িত্বও তাদের।
আবার নালা পরিষ্কার সিডিএর রুটিন ওয়ার্ক না হওয়ায় তারা সেটিকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। সবমিলিয়ে ৯ বছর ধরে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার নানা কাজ চলমান থাকলেও বাস্তবে নগরবাসী কোনো সুফলই পাচ্ছেন না।
জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি ও কোনোপ্রকার ত্রুটি আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে ২ বছর আগে চট্টগ্রামে এসেছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ২০২১ সালের জুনে তিনি বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখেন।
ওই সময় তিনি নগরের সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তিনি বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান এবং সিটি মেয়র ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করে একটি তদারকি কমিটি গঠন করে দেন।
কমিটি প্রতি মাসে প্রকল্পের কার্যক্রম ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে ওই কমিটির তেমন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। শুরু থেকে কমিটি কোনো প্রতিবেদন দিয়েছিল কি না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেনি জেলা প্রশাসন।
এদিকে এবছর একমাস আগে বর্ষাকাল শুরু হলেও শুরুর দিকে তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। মাঝে দুয়েকদিন ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ওই সময় নগরের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে।
এ কয়েকদিনের মধ্যে নগরের নিম্নাঞ্চলগুলো বেশে কয়েকবার একবোরে তলিয়ে গেছে। কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি উঠেছে। এতে দৈনন্দিন প্রয়োজনে বের হওয়া লোকজনকে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
পাহাড়, খাল, নদী ও সমুদ্র নিয়ে গঠিত চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে পাহাড় থেকে বালি ধুয়ে নালায় পড়ে।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় দুটি প্রকল্পের একটির কাজ ৭০ শতাংশ এবং আরেকটির ৫৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। জলাবদ্ধতা যেখানে হচ্ছে সেটা কিন্তু নিম্নাঞ্চল।
এখানকার অর্থাৎ লালখানবাজার, জিইসি মোড়, ২ নম্বর গেট, ষোলশহর, মুরাদপুর বহদ্দারহাট, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার ও বাকলিয়াসহ বিশাল এলাকার পানি চাক্তাই খাল দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। এই একটি খাল পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয় বলেই মাস্টারপ্ল্যানে বারৈপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত আরেকটি খাল খনন করা হচ্ছে। যেটি খনন করছে সিটি কর্পোরেশন। সেটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। কাজ শেষ হতে আরও দেড় থেকে দুই বছর লাগবে।
নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বড় দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এর মধ্যে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প’ শিরোনামে একটি প্রকল্প ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়।
এতে ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। পরে সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এখন আবার ব্যয় ও সময় বাড়ানোর প্রস্তাবনা জমা দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
এছাড়া ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ নামে আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের জুনে শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জুনে।
নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বহদ্দারহাট বারৈপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিটি কর্পোরেশন। ২০১৪ সালে ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক)। ২০১৭ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নানা জটিলতায় প্রকল্পটির কাজ খুব বেশি এগোয়নি। বর্তমানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।
‘মহানগরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শিরোনামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের অধীন কর্ণফুলীতে যুক্ত ২৩টি, হালদায় যুক্ত তিনটি এবং বঙ্গোপসাগরে যুক্ত ১৪টি খালের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ৬৯টি পাম্প হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালে। কাজ শুরু হয় ২০২০ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি পাউবো। আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রকল্পের মেয়াদ এখনও বাড়ানো হয়নি, তবে ঠিকাদার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।