রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার দেশের প্রাচীনতম ও ঐতিহাসিক কারাগারের মধ্যে অন্যতম রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার ১৮৪০ সালে পদ্মা নদীর উত্তর তীরে ৬৫.৪১ একর জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। কারাগারের পেরিমিটার ওয়ালের ভিতরে ১৮.৮৮ একর এবং বাহিরে ৪৬.৫৩ জমি রয়েছে। ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজশাহী বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক এর কার্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৭ সালে সিনিয়র তত্ত্বাবধায়কের পদ সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কারা উপ-মহাপরিদর্শক রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের অফিস প্রধান এবং রাজশাহী বিভাগের কারাগারসমূহের বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। বর্তমানে জনবল ১২জন। কারাগারটির বন্দী ধারণ ক্ষমতার অধিক।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের বিরুদ্ধে অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়ই উঠে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্দী বেচাকেনা, অর্থের বিনিময়ে সুস্থ বন্দীদের হাসপাতালে ভর্তি, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধ মাদকদ্রব্য কারা অভ্যান্তরে প্রবেশ,বাণিজ্য, চড়া মূল্যে খাবার বিক্রি ইত্যাদি।
আবারও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে লাখ লাখ টাকার হাজতি বানিজ্যসহ চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, করাগারে থাকা হাজতিদের এক ওয়ার্ড থেকে আরোক ওয়ার্ডে বদলি করে লাখ লাখ টাকা ও সুস্থ হাজতিদের কেন্দ্রীয় করাগারের হাসপাতালে রেখে লাখ লাখ টাকার বানিজ্য চলছে। আর এসব টাকা কিছু অসাধু কয়েদি ও জেলখানার কিছু কর্মকর্তারা ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন প্রতিমাসে।
সাম্প্রতিক সময়ে জেল থেকে বের হয়ে আসা টিকপাড়ার ও কেদুর মোড়ে বেশ কিছু হাজতির কাছ থেকে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার বর্তমানে অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। জেলখানার কেস টেবিলের ওয়েটার কয়েদী এবং কারারক্ষী সুবেদারের যোগসাজসে বিভিন্ন হাজতিদের এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে বদলি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এরা হাজতিদের কখনও সিভিল থেকে পদ্মা ওয়ার্ডে, যমুনা ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে তাদের ইচ্ছা মতো বদলি করে টাকা দাবি করে থাকে কয়েদিদের কাছে।
এছাড়াও বিভিন্ন ওয়ার্ডে হাজতিদের বদলি করতে টাকা নেয় ১ থেকে ২ হাজার টাকা। আবার ১-২ মাস পরে হাজতিদের থাকা ওয়ার্ড কেটে দিয়ে পুনরায় টাকা নিয়ে নতুন ওয়ার্ডে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। আর এসব টাকা সুবেদার ও বাবুদের মাধ্যমে ভাগ বাটোয়ারা করে থাকে তারা। এইসব চলে কারাগারের কেস টেবিলে।
এদিকে কারাগারের জমিতে কী পরিমাণ সবজির আবাদ হয়, তার কোনো হিসাব কারও কাছে নেই। পাঁচটি পুকুরে মাছ চাষ করা হলেও তারও কোনো হিসাব রাখা হয়না। দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা হয়। বন্দীদের খাবার হিসেবে ১৪৫ গ্রাম ডাল দেওয়ার কথা থাকলেও ৫০ গ্রাম করে দেওয়া হয়। কেউ নিম্নমানের খাবার দেওয়ার প্রতিবাদ করলে নির্যাতন করা হয়। কারাগারের জমিতে হওয়া গাছের ফল বন্দীদের না দিয়ে বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
তদন্তে উঠে এসেছে, কয়েদি বা বন্দীরা কোনো অন্যায় প্রতিবাদ করলে বা কাউকে জানালে হাত–পা, চোখ বেঁধে তাঁদের নির্যাতন করা হয়। প্রকৃত অসুস্থ বন্দীদের চিকিৎসা না দিয়ে টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সুস্থদের, যাতে তাঁরা আরামে থাকতে পারেন। কারাগারের ভেতরে মাদকসহ নিষিদ্ধ মালামাল প্রবেশ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়
কেন্দ্রীয় কারাগারের চাল সহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী অবৈধভাবে পাচার হয় বলেও জানা যায়। অবৈধ ভাবে পাচারকালে মোহনপুর থানা পুলিশ কর্তৃক কারাগারের চালের একটি ট্রলি আটক হয়েছিল। পরে তা কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্থক্ষেপে ছাড় পায় ট্রলিসহ চালক। এর পাশাপাশি হাসপাতালের কয়েদি অথবা হাজতিদের দেখা করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হতে হয় অনেক মানুষকে।
বিশেষ সূত্রে জানা যায় কারাগারের ক্যানটিন থেকে পূর্বে মাসিক আয় ১৫ লাখ টাকা হলেও ব্যাপক দূর্ণীতির ফলে তা বর্তমানে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কাগজ–কলমে দেখানো হচ্ছে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা।
এছাড়া বন্দী ও স্টাফ কল্যাণে যে খরচ দেখানো হয় প্রকৃতপক্ষে এই টাকা এসব ক্ষেত্রে খরচ করা হয়না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিধি না মেনে বিল-ভাউচার বানিয়ে খরচ দেখিয়ে সেই টাকা তুলে নেওয়া হয়। এছাড়াও হাজতিদের পরিবারের অভিযোগ কারাগারে প্রয়োজনীয় দ্রব্য কারাগারের দোকান থেকেই ক্রয় করর বন্দীদের দিতে হয়। ফলে এ সুযোগে কারাগারে বিক্রি হয় এমন ৩৫টি পণ্যের মধ্যে ৩৩টির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য নেওয়া হয়। বন্দীদের পরিবারের দাবি এ সব পণ্যের দাম বাজার মূল্যের থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২/৩ গুণ বেশি নেওয়া হয়।
এই অনিয়মের জন্য হিসাবরক্ষক জেলার নিজাম উদ্দিন ও সিনিয়র জেল সুপার আব্দুর জলিল দায়ী বলে অনেকে অভিযোগ করেন।
কারা সূত্রে জানা গেছে, কারাগার হাসপাতালে যে সকল বন্দি ভর্তি রয়েছে তাদের বেশির ভাগই কেউ রুগী নয়। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে দেওয়া হয়। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালে সুস্থ হাজতিদের জন্য কর্তব্যরত ডাক্তার মনে করলেই বন্দীদের হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন এর জন্য জনপ্রতি মাসে ৮ হাজার টাকা বেড ভাড়া
নেওয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কোন কয়েদি ও হাজতি যদি অসুস্থ হয় তাহলেই হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়ার নিয়ম জেল কোড অনুসারে।
কিন্তু এখানে অসুস্থ হাজতিরা কম্বল বিছিয়ে থাকেন মেঝেতে। কনকনে শীতেও তারা বেড পান না। সূত্র মোতাবেক আরো জানা যায় সপ্তাহে দুইদিন সিনিয়র জেলসুপার হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। তখন বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে অচল, বৃদ্ধ, রুগ্ন ও অসুস্থ হাজতিদের এনে মেডিকেলের ড্রেস পরিয়ে বেডে বসানো হয়। আর সুস্থ হাজতিদের বেড থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সাধারণ ওয়ার্ডে।
সুস্থ হাজতিদের মাসিক চুক্তিতে হাসপাতালে রেখে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তারসহ অন্যান্যরা এমন তথ্য পাওয়া গেছে। একজন সুস্থ হাজতিকে ১ মাস হাসপাতালে রেখে ৭/৮ হাজার টাকা করে বেড প্রতি নিয়ে থাকে হাসপাতালের ডাক্তার। এছাড়াও কোন প্রেসক্রিপশন ছাড়া এক প্যাকেট সিগারেট দিলে দেয়া হয় ঘুমের ঔষধ। এ ভাবে লাখ লাখ টাকার বানিজ্য চলছে কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালে।
কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী ২৮ দিনে মাস হওয়ায় টাকা পরিশোধ করতে হয় ২৮ দিনের মধ্যে। ২৮ দিন পূর্ণ হওয়ার দুইদিন আগেই মেডিকেল রাইটাররা সময় জানিয়ে দেয় কখন টাকা জমা দিতে হবে। এরপরে হাসপাতালে বন্দী রুগীর বাড়িতে ফোন দেওয়া হয় কারারক্ষীর মাধ্যমে। এরপর বন্দীদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নগদ অথবা বিভিন্ন বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে ঘুষ নিয়ে থাকেন বলেও জানা যায়। হাসপাতালে যে সব রুগীরা ভর্তি থাকেন তাদের ওষুধ, দুধ, কলা পাউরুটি সরকারিভাবে দেয়ার নিয়ম আছে। যেহেতু তথাকথিত রোগীরা ভর্তি থাকেন তাই তাদের এগুলো দেওয়া লাগেনা। এই সমস্ত সরকারি খাদ্য তখন তারা বাইরে বিক্রি করে দেয়।
বর্তমানে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালে দায়িত্বে আছেন সহকারী সার্জন ডা: আরেফিন সাব্বির, মেডিকেল অফিসার মুহাম্মদ জুবায়ের আলম, মেডিকেল অফিসার মো: মিজানুর রহমান ও ডিপ্লোমা নার্স মো: উমর ফারুক। তাদের সাথে কারাগার হাসপাতালে হওয়া দুর্নীতির ব্যাপারে জানতে মুঠোফোন যোগাযোগ করা হলে তারা কল রিসিভ করেন নি।
এছাড়াও বড় বড় ভবন আর চকচকে উজ্জল লিখা “রাখিব নিরাপদ দেখাবে আলোর পথ” লেখার আড়ালে কারা অভ্যন্তরে দ্বিগুণ দামে দিলেই মেলে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা। মেডিকেলে মেলে ঘুমের বড়ি এমন অভিযোগ তুলেছে বন্দীদের স্বজনরা।
ভূক্তভোগী অনেক অভিভাবক সূত্রে জানা যায়, তারা মাদকাশক্ত সন্তানকে মামলা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করেন। ছেলে মাদকমুক্ত হবে সেই আশায়। কিন্তু কারাগারে গিয়েও তারা নেশা খায়।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগাররে দুর্নীতি সংক্রান্ত এমন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট এসেছে দৈনিক জবাবদিহির হাতে। জেল সুপারের নিয়মিত কারা পরিদর্শনের সময় অসুস্থ বন্দীদের মেডিকেল ড্রেস পড়িয়ে হাসপাতালে রাখা হয়, এবং সুস্থ রুগীকে তাদের হাজতে প্রেরণ করা হয়। সেদিন বন্দীদের ভালো মানের খাবার দেয়া হয়। জেল সুপারের সামনে কোনো উল্টো পালটা কথা বলে না বলার জন্য হুমকি দেওয়া হয়। জেল সুপার চলে গেএল পরিস্থিতি আবার আগের মতো হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ২০১৯ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামান বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) সৈয়দ বেলাল হোসেনকে প্রধান করে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ২০১৯ এর ২৭ নভেম্বর মাসে তদন্ত শেষে ৪৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন।
তদন্ত কমিটি- রাজশাহী কারা প্রশাসনের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আলতাফ হোসেন, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার হালিমা খাতুন, জেলার হাবিবুর রহমান, ডেপুটি জেলার সাইফুল ইসলামসহ ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ পেয়েছিল তদন্ত কমিটি।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছিল।
এবিষয়ে জানতে ফোন করা হলে জেলার নিজাম উদ্দিন ও সিনিয়র জেল সুপার আব্দুর জলিলকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। যার ফলে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য যে সকল তথাকথিত গণমাধ্যম কর্মী কারা কর্তৃপক্ষের অনুগত কর্তৃপক্ষ শুধু তাদেরই ফোন রিসিভ করেন। যাদের ম্যানেজ করতে পারবেন না তাদের ফোন রিসিভ করেন না বলেও অভিযোগ উঠেছে।