রাজধানীর ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসকের গাফিলতিতে মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত রোববার সংঘর্ষে জড়ান বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে তারা ন্যাশনাল মেডিকেল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। ওই ঘটনার জবাব দিতে রোববারই মেগা মানডে’র ঘোষণা করে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার সকাল থেকে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হতে থাকেন। সেখান থেকে হাজারো শিক্ষার্থী ডেমরার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হয় তারা। সেখানে পৌঁছানোর পর মাইকিং করে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করেছে তারা। হামলায় ওই কলেজের ৪২ জন শিক্ষার্থীকে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। বিভিন্ন টেলিভিশনের লাইভ ফুটেজে এই কলেজের কম্পিউটার, খাতাপত্র ইত্যাদি নিয়ে অনেককে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে। তাদের বাধা দেয়া বা রাস্তায় আটকাতে পুলিশ কিংবা অন্য কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।
যাত্রাবাড়ীর কাজলায় অবস্থিত কলেজে সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত আহত ৪২ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষও রয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত ৩ জনকে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে।
এর আগে সোমবার দুপুর ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে কলেজটির বিভিন্ন সামগ্রী ও সরঞ্জাম নিয়ে যায় হামলাকারীরা।
পরে দুপুর ১টার দিকে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনতা এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় যাত্রাবাড়ী এলাকা। ওই ঘটনায় অনেকে আহত হলে তাদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশ, র্যাবসহ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। শিক্ষার্থীদের বাঁধার মুখে তারা প্রথমে কলেজের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। পরে ভেতরে প্রবেশ করেন তারা। পুনরায় সংঘর্ষের আশঙ্কায় ঘটনাস্থলে ৬ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।
এর আগে গতকাল রোববার ন্যাশনাল মেডিকেলে ভুল চিকিৎসায় মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ন্যাশনাল মেডিকেল, কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা চালায় মোল্লা কলেজের নেতৃত্বে বেশকিছু শিক্ষার্থীরা। ওই হামলায় সোহরাওয়ার্দী কলেজের নিজস্ব গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কারসহ ৫টি যানবাহন ভাঙচুর ও কলেজের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল এবং আলমারি ভেঙে টাকা লুট করা হয় বলে জানায় কলেজ প্রশাসন।
এদিকে, মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের অধ্যক্ষ ড. মাহাবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, মারা যাওয়ার খরবটি আমি নিশ্চিত নই। তবে প্রচুর ছেলে কলেজে এসে হামলা ও ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এ সময় বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রের সঙ্গে পিস্তল দিয়ে গুলি চালায়। এতে অনেকেই হতাহত হয়। শিক্ষার্থীদের হামলায় আমাদের ১২তলা ভবনের কোনো কাঁচ আর অক্ষত নেই। ৫টি লিফট, কম্পিউটার ও সায়েন্স ল্যাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হামলাকারী শিক্ষার্থীরা নগদ টাকা, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, সার্টিফিকেট, ৩০০০ এর উপরে ফ্যান, প্রায় ৩০টির মতো ল্যাপটপ, অসংখ্য কম্পিউটারসহ মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস ভাঙচুর ও লুট করেছে। আজকে হামলা হতে পারে সেটি গতকাল রাতে জেনেছি। তবে এমন অবস্থা হবে সেটা বুঝতে পারিনি। শিক্ষার্থীরা এমন করতে পারে আমরা ভাবিনি। শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে কুচক্রী মহল এই কাজ করেছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশ অন্যদিকে চলে যাবে বলে জানান তিনি।
অপরদিকে, ভাঙচুর ও গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরির অভিযোগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের আট হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে গত রোববার রাতে সূত্রাপুর থানায় মামলা করেছেন সংশ্লিষ্ট থানার এসআই এ কে এম হাসান মাহমুদুল কবীর। মামলার এজাহার গতকাল সোমবার আদালতে আসে। ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমানের আদালত এজাহার গ্রহণ করে ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে।
হামলাকারীরা যেভাবে মালামাল লুট করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাতে গণভবনে যে স্টাইলে লুট করা হয়েছিল তার সাথে মিল রয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। বিভিন্ন টেলিভিশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কলেজের চেয়ার-টেবিল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, রাউটারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র অনেকে নিয়ে যাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, গতকাল রোববার ভুল চিকিৎসায় অভিজিৎ হাওলাদার নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগের জের ধরে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালান মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। আগের দিনের হামলার জের ধরে সোমবার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে এই হামলা চালানো হয়।
এদিকে, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। রোববার (২৪ নভেম্বর) কলেজটির অধ্যক্ষের স্বাক্ষর করা বিজ্ঞপ্তিতে কলেজটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
গত দুদিন ধরে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের মঙ্গলবারের পরীক্ষা ‘অনিবার্য কারণে’ স্থগিত করা হয়েছে। এ পরীক্ষার নতুন সময়সূচি ‘শিগগিরই’ ঘোষণা করা হবে। তবে অন্যান্য পরীক্ষার সময়সূচির অপরিবর্তিত থাকবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ ও ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হওয়া সংঘর্ষে কেউ নিহত হয়নি বলে জানিয়ে অপপ্রচার থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে তারা।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, গত ১৬ নভেম্বর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদার ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরে গত ১৮ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়। ওইদিন রাতে তার পরিবার ও কলেজের কিছু শিক্ষার্থী ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ করে হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়। গত ২০ নভেম্বর পুনরায় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ৫০০/৬০০ শিক্ষার্থী ওই হাসপাতালে এসে ভাঙচুর চালায়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ সময় প্রতিবাদকারীদের চাপে হাসপাতালের পরিচালক ৪ জন ডাক্তার ও ২ জন শিক্ষার্থীসহ অভিজিতের চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ওই সময় মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে। সন্ধ্যার পর স্থানীয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে আসে। এ সময় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা সমঝোতা না মানায় উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের দুই ছাত্র আহত হয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে গত রোববার দুপুর ২টার দিকে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পুনরায় ভাঙচুর চালায়। এক পর্যায়ে তারা শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় বলে জানান তিনি।