নানামুখী অপরাধ দমনে ও অপরাধী দমন ও শনাক্তে ২০২১ সালে রাজশাহী মহানগরজুড়ে স্থাপন হয়েছিল সিসি ক্যামেরা। মহানগরীর প্রবেশদ্বারগুলোতেও স্থাপন করা হয়েছিল শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা। এসব সিসি ক্যামেরা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাজশাহী মহানগর পুলিশ স্থাপন করেছিল সাইবার কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার।
সিসি ক্যামেরা স্থাপন রাজশাহী মহানগর পুলিশ চাঞ্চল্যকর ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যা মামলার রহস্য দ্রুত সময়ে উদঘাটন লক্ষে স্থাপন করা হয়েছিল। নগরবাসীর কাছে পুলিশের তখনকার এসব কর্মতৎপরতা ব্যাপক প্রশংসা পেলেও অপরাধ দমনের লক্ষ্য এখনও পূরণ করতে পারেনি।
বিগত দুই বছরে মহানগরীতে অপরাধ প্রবণতা বরং আরো বেড়েছে। মহানগর পুলিশ (আরএমপি) পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। অপরাধ দমনে গঠন করেছেন বিভিন্ন টিম।
কিন্তু, বিশেষ কিছু কারণে অপরাধ দমনে কার্যকর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকের ধারণা আরএমপির কিছু বিতর্কিত ও অসৎ কর্মকর্তাদের জন্যে অপরাধ দমন সম্ভব হচ্ছে না। রাজশাহীর সুশীল সমাজ ও গণ মাধ্যম কর্মীরা মনে করছেন এ সমস্ত অসৎ কর্মকর্তাদের জন্য অপরাধ দমন সম্ভব হচ্ছে না।
কারণ, অসৎ পুলিশ কর্মকর্তারা অপরাধীদের আগেই অভিযান সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। ফলে অপরাধীদের গ্রেফতার করা যায় না। তাই অসৎ পুলিশ কর্মকর্তাদের এখান থেকে বদলি করা হলে অপরাধ দমনে সহায়ক হবে।
ভুক্তভোগী নগরবাসীর অনেকের অভিযোগ, নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিসি ক্যামেরাগুলো রক্ষণাবেক্ষণে যেমন অবহেলা আছে পুলিশের তেমনি অপরাধ দমনে আরএমপির বিভিন্ন থানা পুলিশের মনোযোগেও ভাটা পড়েছে।
এদিকে ভুক্তভোগী নগরবাসীর অনেকের অভিযোগ, রাজশাহী মহানগর পুলিশের অধীন থানাগুলোতে আগের সেই উদ্যেম আর উদ্যোগও যেন কমে এসেছে। ফলে হাল আমলে রাজশাহী মহানগরীতে বেড়েছে চুরি ছিনতাই ও খুনের মতো বড় সব অপরাধ। পুলিশ এসব অপরাধে জড়িতদের ধরতে কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। বিশেষ করে নগরীতে ছিনতাই বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। রাতের নগরে সড়কে বের হলে অনেকেই ছিনতাই আতঙ্কে ভুগছেন। আর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। ফলে ক্রমেই শান্তির নগরীখ্যাত রাজশাহীর মানুষের মাঝে আতঙ্ক আর ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে রোববার রাতে চার ঘণ্টার ব্যবধানে নগরীতে দুজন চিকিৎসক খুনের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার পার হলেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
রোববার দিনগত রাতে নগরীর চন্দ্রিমা থানার কৃষ্টগঞ্জ বাজার থেকে তুলে নিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় পল্লীচিকিৎসক এরশাদ আলী দুলালকে। পুলিশ দুজনকে আটক করলেও হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।
অন্যদিকে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাজেম আলীকে রোববার (৩০ অক্টোবর) দিনগত রাত পৌনে ১২টায় নগরীর প্রাণকেন্দ্র বর্ণালী মোড়ে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাতে খুন করে।
এ ঘটনার দুদিন পরও পুলিশ হত্যার রহস্যের কিনারা করতে পারেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাতের রাজশাহী নগরীতে ছিনতাই চক্রের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বেড়েছে। যে রাতে দুই চিকিৎসক খুন হন সেই রাতেই রাজশাহী রেলস্টেশন এলাকায় সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন দুই কলেজছাত্র কৌশিক ও অভিজিৎ।
ছিনতাইকারীদের ধারাল অস্ত্রের আঘাতে তারা দুজনই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর দিনের বেলায় নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের আঘাতে মাথায় গুরুতর আঘাত পান রাজশাহী কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নিশাদ আকরাম রিংকু। ১৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পঞ্জা লড়ে গত ৩ অক্টোবর তিনি মারা যান। রিংকুর বাড়ি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার সেরাজপুর গ্রামে।
এদিকে গত ৪ অক্টোবর রাতে একদল মুখোশধারী সন্ত্রাসী মাইক্রোবাসে করে এসে কাটাখালী থানার হরিয়ান বাজারের ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী শাহীন আলীর দোকানে ঢুকে তাকে অস্ত্রের মুখে অপহরণের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে শাহীন আলীকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়। এলাকাবাসী শাহীন আলীকে উদ্ধারে এগিয়ে এলে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে সন্ত্রাসীরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এ ঘটনার প্রায় এক মাস অতিক্রান্ত হলেও পুলিশ কাউকে শনাক্ত অথবা গ্রেফতার করতে পারেনি। গুরুতর জখম শাহীন আলী এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর এলাকার ভদ্রা মোড়, সিএমবির মোড়, লক্ষ্মীপুর, টিকাপাড়া (খুলিপাড়া) কেঁদুর মোড়, হোসনীগঞ্জ বেত পট্টি, পাঠানপাড়া, কলাবাগান, অলকার মোড়, হেতম খাঁ, নিউ মার্কেট, তালাইমারী, বিমান সড়ক, বিলসিমলা, সিটিহাট সড়ক, গ্রেটার রোড, সিটি ও রাজশাহী বাইপাসসহ অন্তত ১৫টি ছিনতাইকারী ও কিশোর গ্যাংয়ের দখলে। ছিনতাইকারী ও কিশোর গ্যাং মোটরসাইকেলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পথচারী বা অটোযাত্রী দেখলেই মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, তারা তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশে অভিযোগ করলেও পুলিশ বেপরোয়া কিশোর গ্যাং ছিনতাইকারীদের ধরছে না।
এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, দুই চিকিৎসক খুনের দুটি ঘটনাকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করছি। আশা করছি, দ্রুত সময়েই দুই খুনের রহস্য উদঘাটন হবে । ছিনতাইকারী ও কিশোর গ্যাং সহ সকল অপরাধীরা গ্রেফতার হবে। মহানগর পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছেন।