প্রকাশ: রোববার, ২০ নভেম্বর, ২০২২, ৩:১২ অপরাহ্ন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক জিএস দুরন্ত বিপ্লব অনিচ্ছাকৃত অবহেলাজনিত লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা থেকে পড়ে নিখোঁজ হয়ে মারা যান তিনি।
ঘটনার পাঁচ দিন পর তার মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় অবহেলার কারণে মর্নি সান-৫ লঞ্চের ছয় কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের কোতয়ালী জোনাল টিম।
গত শনিবার (১৯ নভেম্বর) রাজধানীর কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন— লঞ্চের প্রথম মাস্টার হাফেজ মো. সাইদুর রহমান (৩৮), দ্বিতীয় মাস্টার আলামিন (৩৫), ইঞ্জিনচালক মো. মাসুদ রানা (৩৮), ইঞ্জিনচালক ইমন হোসেন (২৩), সুকানী মো. সালমান (২১) ও লঞ্চের সুপারভাইজার ইব্রাহীম খলিল (২৯)।
রোববার (২০ নভেম্বর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান।
তিনি বলেন, গত ৭ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র এবং ছাত্রলীগের জিএস দুরন্ত বিপ্লব ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার কোনাখোলা এলাকা থেকে জিনজিরা সোয়ারিঘাট হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার উদ্দেশে রওনা দেন। পথে তিনি নিখোঁজ হন।
পাঁচ দিন পর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার বুড়িগঙ্গা নদীতে একজনের মরদেহ ভেসে উঠে। সেদিন রাতে মরদেহটি নিখোঁজ দুরন্ত বিপ্লবের বলে নিশ্চিত করেন তার স্বজনরা। এই নিখোঁজ সংক্রান্তে প্রথমে একটি সাধারণ ডায়েরি এবং মৃত্যু সংক্রান্তে পরে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
ওই ঘটনায় পিবিআই ও ডিবি লালবাগ বিভাগ ছায়া তদন্ত করছিল। আমরা ওই ঘটনায় ভিকটিমের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি। সংশ্লিষ্ট এলাকার লঞ্চ, নৌকা, খেয়াঘাটের ইজাদার ও মাঝিদের সঙ্গে কথা বলি। বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ভিকটিমের মুভমেন্ট সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়।
মামলার ছায়া তদন্ত চলাকালে ডিবি লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম ঢাকা মহানগরী এবং কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত মর্নিং সান-৫ লঞ্চের ছয় কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে।
ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে আমরা নানাভাবে জানার চেষ্টা করেছি, মৃত দুরন্তের মৃত্যু রাজনৈতিক কারণে নাকি শত্রুতাজনিত। আমরা কোনো শত্রুর সন্ধান পাইনি। আমরা জেনেছি তিনি নির্ঝঞ্জাট মানুষ। যদিও তার পারিবারিক ঝামেলা ছিল। তিনি কেরানীগঞ্জের কোনাখোলা এলাকায় একাকি থাকতেন। তার নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের কারণে সোনামাটি এগ্রোফার্ম পরিচালনা করতেন। সেখানকার বিভিন্ন পণ্য তিনি প্রতিদিনই ঢাকায় পাঠাতেন।
নিখোঁজের দিন দুরন্ত বিপ্লব তার কর্মচারী হেলালকে সঙ্গে নিয়ে বিকেল ৪টা ৪৪ মিনিটের দিকে কুরিয়ার সার্ভিস বয় গোলাম রাব্বানীর কাছে কিছু সবজির প্যাকেট হস্তান্তর করে বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটের দিকে নূর ফিলিং স্টেশনের কাছাকাছি রাস্তায় ঢাকা থ ১১-৫৮৭৩ সিএনজি অটোরিকশাতে উঠেন।
তিন-চার জন নিয়ে শেয়ারে চলা অটোরিকশাচালক বিল্লালের ভাষ্য মতে, সন্ধ্যা ৫টা ১৫ থেকে ২০ মিনিটের দিকে তাকে জিনজিরা ঘাটে নামিয়ে দেওয়া হয়।
সিসিটিভি ফুটেজ এবং ডিজিটাল মুভমেন্ট বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা পুলিশ নিশ্চিত হয়, জিনজিরাঘাট ও কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ এলাকার নদীর পাড় এলাকাতে ভিকটিম বিপ্লবের সর্বশেষ অবস্থান ছিল। এখানে তিনি অবস্থান করেও কুরিয়ার সার্ভিস বয় গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে পাঠানো সবজি নিয়ে একাধিকবার কথা বলেছেন।
জিনজিরা ঘাট থেকে সোয়ারীঘাটে চলাচল করা খেয়া নৌকার মাঝি শামসু মিয়ার তথ্য মতে, মাগরিবের নামাজের আগে-পরে পাঁচ জন যাত্রীকে নিয়ে তার নৌকা মাঝ নদীতে এলে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া মর্নিং সান-৫ লঞ্চ তার নৌকাকে ধাক্কা দেয়। এতে নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তলিয়ে যায়। যাত্রীরা পানিতে পড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্য নৌকা এসে কয়েকজনকে উদ্ধার করতে পারলেও একজন ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া যাত্রীই নিহত দুরন্ত বিপ্লব বলে জানা যায়।
লঞ্চের কর্মচারীদের অবহেলাজনিত দায়ের কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে উল্লেখ করে ডিসি মশিউর রহমান বলেন, দূর থেকে নৌকার গতিবিধি দেখার কথা। নৌকা যাচ্ছিল আড়াআড়িভাবে, লঞ্চ যাচ্ছিল সোজা। লঞ্চের তো নৌকাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেই মাপ তাদের জানার কথা। নৌকা লঞ্চকে ধাক্কা দিতে পারে না। লঞ্চই নৌকাকে ধাক্কা দিয়েছে। গ্রেপ্তাররা সেটা স্বীকারও করেছে। ধাক্কা দিয়ে চলে যাওয়ার পর দূরে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেখেছে ঘটনা আসলে কি। ততক্ষণে নৌকা তলিয়ে গেছে। নৌকা ডুবিতেই যে বিপ্লবের মৃত্যু হয়েছে তা তার জুতা উদ্ধার ও মোবাইল টাওয়ারের সর্বশেষ অবস্থান অনুযায়ী স্পষ্ট হয়েছে।
গ্রেপ্তারদের লঞ্চ চালানোর অনুমোদন ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এখনও বিআইডব্লিওটিএ’র কাছ থেকে জানতে পারিনি তাদের আদৌ অনুমোদন ছিল কি না। তবে ২১ বছরের সুকানী সালমান পূর্ণ বয়স্ক হলেও অভিজ্ঞতা তার কতটুকু ছিল একটা লঞ্চকে নিয়ন্ত্রণ করার, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।
ময়নাতদন্তের প্রাথমিক বক্তব্যে চিকিৎসক বলেছিলেন, দুরন্ত বিপ্লব হত্যার স্বীকার হয়েছিলেন— এ ব্যাপারে ডিসি মশিউর রহমান বলেন, এ ধরনের কনক্লুশন দেওয়ার দায়িত্ব চিকিৎসকের না। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলতে পারেন না হত্যা নাকি আত্মহত্যা। একজন ব্যক্তি ছাদ থেকে লাফিয়েও আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যেতে পারেন। দুরন্ত বিপ্লব নৌ ডুবিতে ডুবে যান, তিনি হয়ত সাঁতারে পটু ছিলেন না বা জানতেন না। তার মরদেহ উদ্ধার করা হয় পাঁচ দিন পর। এসময়ের মধ্যে তিনি নিখোঁজ থেকে শুরু করে উদ্ধার পর্যন্ত যেকোনো পর্যায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারেন। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলতে পারেন, কিন্তু হুট করে বলতে পারেন না হত্যা, অবহেলাজনিত মৃত্যু নাকি আত্মহত্যা।
-জ/অ