প্রকাশ: শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ১:২১ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ১:২৩ অপরাহ্ন
পশ্চিম এশিয়ার বর্তমান সংকটগুলোর কারণ গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হলে ১৯১৬ সালের ১৬ মে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত সাইকস-পিকো চুক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা লাভ করতে হবে। ওই চুক্তি পশ্চিম এশিয়ার ভবিষ্যত নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এ অঞ্চলে বর্তমানে যেসব সংকট চলছে তার ভিত্তি রচনা করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ওসমানী খেলাফতের পতনের পর এই খেলাফতের অধীনে থাকা ভূখণ্ডকে তিন ভাগে ভাগ করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন প্রধান তিন উপনিবেশবাদী শক্তি ফ্রান্স, ব্রিটেন ও রাশিয়া। এসব দেশ তাদের নিজ নিজ স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে এই ভাগবাটোয়ারা সম্পন্ন করে; এখানে ওসমানী সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক কিংবা জাতিগত বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। যে চুক্তির বলে এই ভাগাভাগি হয় সেটির স্থপতি ছিলেন ব্রিটিশ রাজনীতিক মার্ক সাইকস ও ফরাসি রাজনীতিক ফ্রাঁসোয়া জর্জেজ পিকো। এ কারণে তাদের নাম অনুসারে এ চুক্তির নাম হয় সাইকস-পিকো চুক্তি।
ওই চুক্তির বলে পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্র নতুন করে কৃত্রিমভাবে ঢেলে সাজানো হয় যেখানে এ অঞ্চলের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি। ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় এবং ওই যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে ওসমানী খেলাফতের পতন হয়। কিন্তু ওই খেলাফতের পতনের পরও আরব দেশগুলো একটি একক শাসনের অধীনে থাকবে বলে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফরাসি ও ব্রিটিশ সরকার ওসমানী খেলাফতের পতনকে তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের উপযুক্ত সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। ওই দুই উপনিবেশবাদী দেশ পশ্চিম এশিয়ার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে এ অঞ্চলকে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।
এই ভাগাভাগির কারণে পশ্চিম এশিয়ায় শুধু যে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয় তাই নয়, সেইসঙ্গে ধর্মীয় ও মাজহাবগত দ্বন্দ্বও চরমে পৌঁছে। ফিলিস্তিন, জর্দান, দক্ষিণ ইরাক এবং সিরিয়া ও লেবাননের একাংশ সরাসরি ফরাসি ও ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায়। আর ওই নব্য দখলদারিত্বের জের ধরে গত এক শতাব্দি ধরে এই অঞ্চলে যুদ্ধ ও সংঘাত লেগে রয়েছে।
ইরানের পশ্চিম এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক মোহাম্মাদ-রেজা হাজিয়ানের মতে, সাইকস-পিকো চুক্তির সবচেয়ে বড় ভুল ছিল পশ্চিম এশিয়াকে ভাগাভাগি করার সময় এ অঞ্চলের সামাজিক ও রাজনেতিক বাস্তবতা উপেক্ষা করা। তিনি বলেন, এই চুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার দাবি উপেক্ষা করে এই ভূখণ্ডকে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে নিয়ে যাওয়া।
বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ার বহু দেশ সাইকস-পিকো চুক্তির বিধ্বংসী প্রভাবে অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে, বিগত কয়েক দশক ধরে ইরাক ও তুরস্কের মধ্যে যে সীমান্ত সমস্যা বিরাজ করছে তার কথা উল্লেখ করা যায় যা সাইকস-পিকো চুক্তির ভিত্তিতে একটি কৃত্রিম মানচিত্র তৈরিরই ফসল।
ফিলিস্তিন বিষয়ক ভাষ্যকার মাহদি শাকিবায়ীর মতে, সাইকস-পিকো চুক্তি ছিল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড জবরদখল করে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দলিল। তিনি বলেন, ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পেছনে ব্রিটেনের প্রধান লক্ষ্য ছিল পশ্চিম এশিয়া ও ফিলিস্তিনের তেল সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ১৯১৬ সালে সাইকস-পিকো চুক্তি স্বাক্ষরের পরের বছরই ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইসরাইল নাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা জানান দেয় ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটেন ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদি শরণার্থীদের ঢল নামায় এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসবাসকারী ইহুদি জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। ১৯১৭ সালে যেখানে ফিলিস্তিনের মূল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইহুদির সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ শতাংশ সেখানে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার বছরে ফিলিস্তিনের ইহুদি জনসংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়। ততদিনে এই ভূখণ্ড থেকে গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন ও জবরদস্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনের ৮ লাখ মূল অধিবাসীকে বিতাড়িত করা হয়।
ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালে এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি জনগণের গত ১০০ বছরের দুর্দশার জন্য ব্রিটেনকে দায়ী করে এজন্য ব্রিটিশ সরকারকে ফিলিস্তিনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার আহ্বান জানায়। কিন্তু ওই আহ্বানের জবাবে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেন, বেলফোর ঘোষণার জন্য ব্রিটিশ সরকার গৌরব বোধ করে।
সূত্র: পার্স টুডে