ক্লাসের বই রেখে অন্য বই পড়লে মা-বাবা খুব রাগ করে। সারাদিন ক্লাসের বই ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারিনা৷ বই কিনেছো কি না তা জিজ্ঞেস করলে এমনটাই উত্তর পাওয়া যায় বইমেলায় ঘুরতে আসা এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে। সেই শিক্ষার্থী প্রতিবেদককে বলেন, আমার বই পড়তে ভালো লাগে। বই পড়তে চাই। তবে ক্লাসের বই রেখে অন্য বই পড়তে চাইলে মা-বাবা খুব রাগ করে। যদি মা-বাবা রাগ করে তাহলে এই বইমেলায় আসলে কিভাবে? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষার্থী বলেন, প্রাইভেট ফাঁকি দিয়ে এসেছি৷ বই দেখতে। মা-বাবাতো কিনে দিবে না আর আমার কাছেতো টাকা নাই, থাকলে অনেকগুলো বই কিনতাম।
বই একটি মানুষকে সমৃদ্ধ করে তোলে। তাই হয়তো বইয়ের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে কবি ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম মানবজীবনে বইয়ের স্থানকে এভাবেই নির্ধারণ বলেছিলেন যে- ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে; কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়।’ জীবনের সব বস্তুগত উপকরণ হারিয়ে গেলেও, সময়ের কালে ধুলোয় মলিন হলেও বই থাকে চির যৌবনে আসিন।
যেখানে আমাদের জীবনে বইয়ের গুরুত্ব এতখানি সেখানে আমরা কি আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে সেই বই থেকে দূরে রাখছি শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের আশায়? আমরা কি নিজেরাই আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে সৃজনশীল মেধাবী ও সুদক্ষ ভাবে গড়ে ওঠার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি? প্রশ্নটি সকলের কাছে।
গত ২১’শে ফেব্রুয়ারী (বুধবার) পটুয়াখালীতে শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। পটুয়াখালী ডিসি স্কয়ার মাঠে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ৯ দিনব্যাপী বইমেলার আজ ৪র্থ দিন। সারেজমিনে মেলায় গিয়ে দেখা যায়, মেলায় পর্যাপ্ত বই থাকলেও নেই আশানুরূপ ক্রেতা। যা নিয়ে হতাশ বই বিক্রেতারা। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় বর্তমান প্রজন্ম বই পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে মনে করেন অনেকেই।
অন্যান্য মেলার তুলনায় এই বইমেলায় মানুষের উপস্থিতিও বেশ কম লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান প্রজন্মের সাথে বইয়ের মেলবন্ধনের লক্ষ্যে সরকারিভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে দেখা গেলেও তার ফলাফল আশানুরূপ দেখা যায় না৷ বর্তমান প্রজন্মের ইন্টারনেটের দুনিয়ায় অবাধ বিচরনের ফলে তারা বই পড়া থেকে বিমুখ হচ্ছে। প্রতিবেদকের জরিফে দেখা যায় ইন্টারনেটের ভালো দিকের তুলনায় মন্দ দিকেই তাদের চলাচল বেশি। স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব, ভিডিও গেমস নিয়ে ব্যস্ত হতে দেখা যায় তাদের। প্রযুক্তির ব্যবহার খারাপ না, তবে এর অতিব্যবহার ও অপব্যবহার তাদের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে। তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। রোবট হয়ে যাচ্ছে তারা। ভালোর থেকে খারাপ হচ্ছে বেশী। এর সমাধান হতে পারে তাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে। তবে সেখানে দরকার অভিভাবকদের সজাগ দৃষ্টি। প্রযুক্তির অতি ব্যবহার যেমন মানসিক অবসাদের সৃষ্টি করে, বই পড়লে তেমনি মানসিক অবসাদ দূর হয় এবং মন প্রফুল্ল থাকে।
বই পড়লে একাগ্রতা বাড়ে, জ্ঞান ও কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পায়, ভালো ঘুম হয়, একাকিত্ব দূর হয়, মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ে, লক্ষ্য পূরণে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, শব্দ ভান্ডার বাড়াতেও সাহায্য করে। বই পড়লে মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়। জনাথন সুইফট বলেন, ‘বই হচ্ছে মস্তিষ্কের সন্তান’। অর্থাৎ, বই পড়লে মস্তিষ্কের কোষগুলো উদ্দীপিত হয় ও স্নায়ুগুলো উজ্জীবিত হতে থাকায় বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাশক্তি জাগ্রত হয়। ফলে লিখন ও পাঠন দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। তবে এখন আমরা এগুলোর তোয়াক্কা না করে শুধুই শর্টকাট খুঁজছি।
বইমেলায় বিক্রেতা কাওসার আহমেদ বলেন, আমাদের অভিভাবকদের দেখা যায় শুধু তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে ঠেলে দিচ্ছে ‘এ’ প্লাস অর্জনের দিকে। শুধু পড়তে হবে আর পাশ করতে হবে৷ এর বাইরে জেনো আমরা ভাবতেই ভুলে গেছি। এর ফলে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম অদক্ষ হয়ে গড়ে উঠছে, সৃজনশীলতায় নিজেদের মস্তিষ্ককে বিকাশিত করতে পারছে না। যার কারনে দায়ী আমরাই৷
পটুয়াখালী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মোঃ রুবায়েত হক মেহেদী বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন প্রতিবছর ফেব্রুয়ারী এলে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম কবে শুরু হবে বইমেলা। তবে এখন বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সেই উৎসাহ উদ্দীপনা খুব কম লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান প্রজন্মকে সৃজনশীল মেধাবী প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদেরকে মোবাইল বাদ দিয়ে বইয়ের গুরুত্ব বোঝাতে হবে৷ বই পড়ার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। নাহলে তারা ধীরে ধীরে মেধা শূন্য হয়ে পড়বে যা আমাদের দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
প্রতিদিন কেমন বই বিক্রি হচ্ছে তা জানতে চাইলে উত্তম বই ঘরের স্বত্বাধিকারী বই বিক্রেতা উত্তম দাস বলেন, বই বিক্রির অবস্থা খুবই খারাপ। মেলায় জনসমাগম খুবই কম। যাও দর্শনার্থী টুকটাক আসেন তারা এসে বই দেখে ঘুরেফিরে চলে যায়। প্রতিদিন খরচের টাকাটাও ঠিকমতো ওঠে না।
মেহেদী ইসলাম নামের এক বই বিক্রেতা বলেন, আমার মনে হয় বই মেলাটা আগে যে সদরে আলাউদ্দিন শিশু পার্কের মধ্যে হতো মেলাটা সেখানে হলেই ভালো হয়। তাহলে মনে হয় মানুষের উপস্থিতি আরও বেশি হবে। আর তাছাড়া শহরে এই মেলার কোন তেমন প্রচার প্রচারণাও নেই। যদি একটু বেশি প্রচারণা চালানো যেতো তবে বোধহয় আর বেশি মানুষ আসতো৷
পটুয়াখালী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শিক্ষানুরাগী ও নাট্যজন প্রফেসর এম নুরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান প্রজন্মের বইয়ের প্রতি যে অনাগ্রহতা দেখা দিয়েছে তার জন্যে আমরাই দায়ী৷ প্রতিটি অভিভাবক যদি তার সন্তানকে শুধু ভালো ফলাফলে আশায় না ছুটিয়ে তাদেরকে সৃজনশীল করে গড়ে তোলার চেষ্টা না করে তবে অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়তে হবে আমাদের। জীবনকে জানতে হলে, নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হলে বই পড়ার কোন বিকল্প নেই৷ আমাদের উচিৎ প্রতিটি ঘরে ঘরে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।
জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক নাট্যজন মুজাহিদ প্রিন্স বলেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে প্রথমে আমাদেরকে সোনার মানুষ তৈরী করতে হবে৷ যা শুধু ক্লাসে প্রথম হওয়াটাই শেষ কথা নয়৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনো ক্লাসে প্রথম হয়নি। আমাদের বাবা-মায়েদের এই প্রথম হওয়ার ভ্রান্ত ধারনা ত্যাগ করতে হবে। পড়াশুনার পাশাপাশি বাচ্চাদেরকে বই পড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত করতে হবে। এই বর্তমান প্রজন্মকে সৃজনশীল মেধাবী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তার পাশাপাশি আমরা যারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ রয়েছি তারাও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি এই প্রজন্মটাকে ইন্টারনেট ও শুধুই ভালো ফলাফলে এই ভয়াল নেশা থেকে রক্ষা করতে। আমাদের সাথে সাথে প্রতিটি অভিভাবকের উচিৎ তার বাচ্চাকে সৃজনশীলতার মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলা। তবেই তার সন্তান সোনার মানুষ হবে আর আমাদের দেশ হবে সোনার বাংলাদেশ।