
বিগত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য মিথ্যা ও ভূয়া মামলা। আর মামলার আসামীরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও এজাহারে দেয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগের ভূয়া পদ-পদবী। ভয়ঙ্কর মিথ্যা মামলা চক্রের সদস্যরা ওইসব মামলার বাদীকে চাকরী ও মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে তাদের দেয়া বিভিন্ন ব্যক্তির নাম-ঠিকানা ও ভুয়া পদ-পদবি দিয়ে মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
এছাড়াও পূর্ব শত্রুতার জেরে হয়রানির উদ্দেশ্যেও বিভিন্ন নিরাপদ মানুষকে মামলার আসামী করা হয়েছে। এছাড়াও ভূয়া মামলা দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে আসামীদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে আনার পর পুনরায় নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে নিরাপরাধ মানুষকে কারাগারে রাখার ঘটনাও ঘটছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুরের ভাষানটেক ও কাফরুল থানা এলাকায় একটি চক্র বাদীদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে পূর্ব শত্রুতা ছিল এমন ব্যক্তিদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি শুরু করে। একই ব্যক্তিকে একাধিক মামলার আসামী বানাচ্ছে। মামলার পর টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে মামলার মোটা অংকের টাকায় তাকে গ্রেপ্তার করিয়ে জেলে পাঠানো ও নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। হয়রানি করতে রিমান্ডে এনে নির্যাতন চালাতে মোটা অংকের টাকা দেয়া হচ্ছে।
আরও জানা যায়, মামলা চক্রের সদস্যরা হেলেনা আক্তার নামের এক গৃহবধূর বিরুদ্ধে মামলা করে। আর কোন ধরণের তদন্ত না করেই গ্রেপ্তার করা হয় হেলেনা আক্তারকে। মামলায় তাকে আওয়ামীলীগের ভুয়া ওয়ার্ড সহ-সভাপতি বানায়। এছাড়াও তার নামে ভাষাণটেক থানায় আরেকটি মিথ্যা মামলা দিয়ে শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয়। পরে তদন্ত কর্মকর্তা তাকে একদিনের রিমান্ডে আনেন। গতকাল রোববার তাকে কারাগার থেকে কাফরুল থানায় আনা হয়। কিন্তু ওই মামলা সম্পর্কে হেলেনা কিছুই জানতো না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সহসভাপতির নাম রহিমা সরকার, তার স্বামীর নাম কামরুল সরকার কিন্তু তার নাম বাদ দিয়ে সহসভাপতি হিসেবে হেলেনার দেয়া হয়। সে কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত না করে এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের না জানিয়েই হেলেনাকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে আনেন।
এদিকে, হেলেনার মা রাহেলা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, হেলেনা অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাকে স্থানীয় এলাকায় প্রতিবাদী হেলেনা হিসেবে চেনে। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা রাজীব চৌধুরী, হাজি বাপ্পী, সম্রাট ইমু হেলেনার গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা কেড়ে নিয়ে তাকে পথে বসিয়ে দেয়। সে এর প্রতিবাদ করায় রাজীব চৌধুরী মোটা অংকের টাকা দিয়ে বাদী সাজিয়ে তাকে মিথ্যা মামলার আসামী বানিয়েছে। এমতাবস্থায় তিনি তার মেয়ের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও তার মুক্তির দাবি জানান।
এ প্রসঙ্গে জানতে, কাফরুল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রবিউল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এদিকে ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
অপরদিকে, ঢাকা জেলার সাভারের আশুলিয়ায় কুলসুম বেগম নামের এক নারীকে চাকরির প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে জীবিত স্বামী আল আমিনকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যার অভিযোগ এনে ঢাকার আদালতে মামলা করানো হয়। ওই মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও আসামি হিসেবে ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। পরে ১৩ নভেম্বর আল-আমিন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় গিয়ে নিজের জীবিত থাকার বিষয়টি পুলিশকে জানালে তাকে সাভার থানায় আনা হয়। অন্যদিকে মামলা করে আদালতে হাজির হচ্ছিলেন না কুলসুম। পরে তার বিরুদ্ধে সমন জারি করেন আদালত। পরে থানা পুলিশ তাকে আটক করে নিয়ে আসেন।
পুলিশি হেফাজতে এসে কুলসুম (২১) জানান, মানিকগঞ্জের ঘিওর থানা এলাকার রুহুল আমিন (৬৪) ও শিবালয় থানার টেপড়া এলাকার শফিউদ্দিন (৪০) তাকে ফাঁদে ফেলে চাকুরি ও টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে দিয়ে মামলাটি করানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
মিথ্যা মামলার আসামী লিয়াকত দেওয়ান নিজেকে ওই মামলার ৫৭ নম্বর আসামি বলে দাবি করেন এবং তার নাম প্রত্যাহারের কথা বলে একটি চক্র তিনিসহ একাধিক আসামির কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। কিন্তু তার নাম কাটা হয়নি বলে জানান তিনি।
এছাড়াও বগুড়ায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে শেখ হাসিনাসহ ১৬০ জনের নামে ফোরকান হত্যা মামলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের পিতা আব্দুল কুদ্দুস। আদালতে করা যুবদল নেতা ফোরকান আলী হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের জন্য পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেন। সেই সঙ্গে এই হত্যা মামলা প্রত্যাহার করতে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে আবেদন করেন।
আবদুল কুদ্দুস বলেন, তিনি বা তার পরিবারের কেউ এই হত্যা মামলা করেননি। মামলাটি অন্য একজন মিথ্যা তথ্য দিয়ে করেছেন। সেই সঙ্গে সেই বাদী ও তার সাক্ষীরা এই মামলায় বিভিন্নজনকে আসামি করার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছেন। ওই ঘটনার ১১ মাস পর গত বছরের ১ নভেম্বর বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (শাজাহানপুর) আমলি আদালতে শাজাহানপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস আলী বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলা দায়েরের পর থেকেই বাদী ইউনুস আলী আসামিদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি ও অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে মামলায় ফাঁসানোর ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করছে বলে জানান তিনি।