আগাম কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে গত কয়দিনের বৃষ্টিতে হাওর-বাওরে আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে বোরো ধান। ফলে পানিতে ডুবে যাওয়া কাঁচা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, আরও দুই সপ্তাহ সময় পেলে হয়তো পুরোদমে ধান কাটা শুরু হতো। কিন্তু শ্রমে ঘামে ফলানো বোরো আবাদ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তারা। অতিবৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে হাওরে আগাম বন্যায় নিমজ্জিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চলের ধানক্ষেত । তাই ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষায় কাঁচা ধান কেটে ফেলতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের হাকালুকি হাওরে ব্যাপক বোরো ফলন হয়েছে। কিন্তু আগাম বন্যায় কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে শ্রমিক লাগিয়ে কাঁচা ধান কেটে ফেলতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাওর পাড়ের বাসিন্দা সেলিম আহমদ।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় এ পর্যন্ত ১৩০ হেক্টর জমির বোরো ধান নিমজ্জিত হয়েছে। আর বৃষ্টি না হলেও বেশি ক্ষতি হবে না। তবে কৃষকেরা বলেছেন, নিমজ্জিত জমির পরিমাণ আরও বেশি। অনেক কৃষক এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
আজ বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, হাকালুকি হাওরে কৃষকরা তড়িঘড়ি করে কাঁচা ধান কেটে তুলছেন বলে জানান কৃষক মামুন মিয়া ও ময়েজ মিয়াসহ আরও অনেকে।
তারা জানিয়েছেন, অনাবৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টির কারণে জমিতে ধান রাখা যাচ্ছে না। তাছাড়া এখন পাহাড়ি ঢলে হাওরে পানি বাড়তে শুরু করেছে। যে কারণে কাঁচা ধান কেটে ফেলতে হচ্ছে। গত কয়েক দিন ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে, সঙ্গে শিলাবৃষ্টিও ছিল। এমন বিরূপ আবহাওয়ায় হাওরের বোরো ধান নিয়ে চিন্তায় আছেন তারা।
কৃষকরা আরও জানান, হাওর ও নদীতে পানি বাড়ায় কৃষকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি ও উজানের ঢলে নিমজ্জিত কাঁচা, কোথাও আধা পাকা ধান কাটার চেষ্টা করছেন অনেকে। এ সময় হাওর এলাকায় বৃষ্টি, ভারী বৃষ্টি, উজানের পাহাড়ি ঢল, আগাম বন্যার শঙ্কা থাকে। যদি এসবের কোনো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাওরে হয়, তাহলে কৃষকের সর্বনাশ হয়ে যায়।
এদিকে সিলেটের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সুনামগঞ্জ জেলার কৃষকরা। ইতোমধ্যে হাওরে জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার। তারা জলাবদ্ধ হাওরের পানি নিষ্কাশনের উদ্যোগ নেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারি সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন।
জেলা প্রশাসক বলেছেন, বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদীতে পানি কিছুটা বাড়লেও বিপৎসীমার অনেক নিচে আছে। আমরা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছি। কৃষকেরা দেখার হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য যে স্থানটির কথা বলেছেন, আমরা সেটি দেখে ব্যবস্থা নেবো। হাওরের ফসল কৃষকেরা যাতে নির্বিঘ্নে গোলায় তুলতে পারেন, এজন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে।
স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলাবদ্ধতার বিষয়টি সবাই জানেন। ভাটির বাঁধ কেটে দিলেই পানি নিষ্কাশন হবে। কিন্তু আগাম বন্যা হলে তখন ওই বাঁধের কেটে দেওয়া অংশের কারণে পুরো হাওরের ফসল ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তাই প্রশাসন ও পাউবো কর্মকর্তারা এই ঝুঁকি না নিয়ে অন্য কোনোভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় কি না, চিন্তা করছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরে দুই লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২শ টন। হাওর এলাকার কৃষকেরা নির্বিঘ্নে এই ধান গোলায় তুলতে পারলে ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকার ধান উৎপাদন হবে সুনামগঞ্জে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, এবার সুনামগঞ্জে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে বোরো রোপণ হয়েছে। আমরা সব হাওরেই খোঁজ রাখছি। যাদের ক্ষতি হবে, তাদের সহায়তার চেষ্টা করা হবে। তবে পানি কমে গেলে ক্ষতি কম হবে। সুনামগঞ্জে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল থেকে বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল রক্ষায় প্রতিবছর প্রশাসন ও পাউবো ৪০টি হাওরে ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ করে। এবার জেলার ১২টি উপজেলায় ৭৩৫টি প্রকল্পে ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে। এতে প্রাক্কলন ধরা আছে ১৩০ কোটি টাকা। ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। পরে সময় আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ও হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত জেলা কমিটির সদস্যসচিব মো. মামুন হাওলাদার বলেন, এখন অবশ্য ভারী বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস নেই। সুনামগঞ্জে ও উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। এতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না।