
দেশের ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে, যার প্রতিফলন দেখা গেছে আমানত প্রবৃদ্ধিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৯ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি। এই বৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয় যে, কয়েক মাসের অস্থিরতা, তারল্য সংকট এবং ব্যাংকে রাখা অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের পর আমানতকারীদের মনোভাব ইতিবাচক দিকে মোড় নিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, আন্তঃব্যাংক ও সরকারি আমানত বাদে ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাঁড়িয়েছে ১৭ লক্ষ ৯২ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই পরিমাণ ছিল ১৬ লক্ষ ৬১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমানত ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.২৮ শতাংশ। এর আগে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ৭.৪৪ শতাংশ, নভেম্বরে ৭.৪৬ শতাংশ, অক্টোবরে ৭.২৮ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ৭.২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। প্রতি মাসে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত বেড়েছে। জানুয়ারিতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লক্ষ ৮১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, ডিসেম্বরে ১৭ লক্ষ ৭৬ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা এবং নভেম্বরে ছিল ১৭ লক্ষ ৬২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা মনে করছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে আসা এবং নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ায় জনগণের মধ্যে উদ্বেগ হ্রাস পেয়েছে, যা আমানত বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। তারা উল্লেখ করেন, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে ব্যাংকিং খাত ব্যাপক অনিয়ম, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, আগ্রাসী ঋণ প্রদান এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোকে বিতর্কিত ব্যাংক লাইসেন্স প্রদানের মতো সমস্যায় জর্জরিত ছিল। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই উদ্বেগ চরমে পৌঁছায় এবং বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বারবার আশ্বাস এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সরাসরি তারল্য সহায়তা প্রদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে আর্থিকভাবে দুর্বল ছয়টি ব্যাংকে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি জোগান দিয়েছে, যা তাদের আমানত পরিশোধের চাপ সামলাতে সহায়তা করেছে। এর পাশাপাশি, আমানতের সুদের হার বৃদ্ধিও ব্যাংকগুলোকে সঞ্চয়কারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণেও। ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকের বাইরে থাকা মুদ্রার পরিমাণ কমে ২.৭১ লক্ষ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ২.৭৪ লক্ষ কোটি এবং ডিসেম্বরে ২.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে মোট আমানতের মধ্যে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬ লক্ষ কোটি টাকা এবং চাহিদা আমানত ছিল ১.৯০ লক্ষ কোটি টাকা, যা নির্দিষ্ট মেয়াদের সঞ্চয় স্কিমের প্রতি মানুষের আগ্রহকেই নির্দেশ করে।
আমানত বাড়ার পাশাপাশি ঋণ বিতরণও বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ ২২ লক্ষ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ২১.৮৯ লক্ষ কোটি টাকা এবং ডিসেম্বরে ছিল ২১.৭৭ লক্ষ কোটি টাকা।
যদিও বর্তমান পরিসংখ্যান ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন যে, টেকসই স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য গভীর কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। খেলাপি ঋণ, ঋণ বিতরণে জবাবদিহিতার অভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মতো পুরনো সমস্যাগুলোর ব্যাপক সমাধান প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
ইতিমধ্যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা, তদারকি বিধি সংশোধন এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করছে বলে মনে করা হচ্ছে।