কোটা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে উদ্ভুত সহিংস পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। শহরাঞ্চলে লোকজনের স্বাভাবিক চলাফেরা না থাকায় দিনমজুর, হকার, পরিবহন শ্রমিকসহ অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকেই ধারকর্জ করে দুই বেলা খাবার জোগার করছেন। যারা তা পারছেন না অনাহারে-অর্ধারে দিন কাটছে তাদের।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ গ্রামের অটোচালক রাশিদ মিয়া, রশিদাবাদ গ্রামের ফজল মিয়াসহ অনেক অটোকচালক বলেছেন, গত চার দিন অটো নিয়ে তারা বের হতে পারেননি। ফলে তাদের রুজি-রোজগার বন্ধ। এ অবস্থায় তারা তাদের সন্তানসহ পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন্ তারা বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের কাছ থেকে ঋণ করে পরিবারে খাবার জোগান দিচ্ছেন।
হাওরের নৌকার মাঝি কেরামত মিয়া ও সুলতান মিয়া বলেন, বর্ষার এই সময়ে হাওর ভ্রমণে শত শত লোকজন আসে। কিন্তু আন্দোলনের কারণে ৬ দিন ধরে কোনো ভ্রমণকারী হাওরে আসেননি। তাই হাওরের মাঝিমাল্লা, অটোচালক, বাইকচালক, হোটেলের কর্মচারী সবাই বেকার হয়ে পড়েছে।
রাজশাহীর গবা উপজেলার সুরত আলী জানান, গ্রামে কাজ না থাকায় তিনি শহরে আসেন দিনমজুরের কাজ করতে। তবে তিন দিন ধরে তাকে কেউ কাজে ডাকছে না। বাড়িতে চার ছেলেমেয়ে। সবাই পড়ালেখা করে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। সুরত আলীর মতো আরো অন্তত ২০জনকে দেখা যায় তালাইমারি মোড়ে বসে রয়েছেন।
কারফিউ জারি করার পর থেকে বেকায়দায় পড়েছে এই সুরত আলীর মতো দিনমজুর ও শ্রমজীবি শ্রেণির মানুষ। রিকশাচালক, কুলি থেকে শুরু করে শ্রমিক সবার মাঝেই হতাশা বিরাজ করছে। পরিবার নিয়ে এদের অনেকেই দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। ১৯ জুলাই রাতে কারফিউ জারির পর থেকে সকল দোকানপাট বন্ধ, বন্ধ যানবাহান চলাচল।
নগরীর অটোরিকশা চালক মো. সাগর বলেন, প্রতিদিন পরিবারের ব্যয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। কারফিউর ফলে গত দুদিন ধরে গাড়ি বের করতে পারছি না। প্রথম দিন বের করে পুলিশের মার খেতে হয়েছে। সংসারের খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। দেশ এভাবে চলতে থাকলে আমরা সন্তানদের নিয়ে না খেয়ে মরব।
এদিকে সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় রাজশাহীতে যেসব যুবক অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং করে তারাও পরেছেন বিপাকে। সৌরভ হোসেন নামে একজন বলেন, অনার্স পাসের পর কোথাও চাকনি না পেয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করছি। রাজশাহীতে আমার মতো কয়েক হাজার যুবক ও শিক্ষার্থী এই পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছেন। গত ৪দিন থেকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বায়ারদের কাজ বুঝিয়ে দেয়া যায়নি। তাদের কাছ থেকে আগের কাজের অর্থও পাওনা রয়েছে। এমন অবস্থায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছি। ইন্টারনেটের কারণে বায়ারদের আমাদের প্রতি বিরুপ ধারণা সৃষ্টি হবে।
রাজশাহীর অন্যতম বৃহৎ হাট পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর হাট। আমের মৌসুমে রমরমা ব্যবসা চলছিল হাটে। হঠাৎ দেশের মধ্যে অনাকাঙ্খিত এমন পরিস্থিতিতে আম ব্যবসার ছন্দপতন ঘটেছে।
নারী উদ্যোক্তা ও রাজশাহী বিভাগের নির্বাচিত জয়িতা পরিনা বলেন, আমি আমের সময় আম আর গুড়েরর সময় দগু সরবরাহ করি। এই পরিস্থিতিতে আম শতাধিক উদ্যোক্তা তাদের অর্ডার বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। কুরিয়ার সার্ভিস ও অনলাইন বন্ধ থাকার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
রাজশাহীর জেলা প্রশাকক শামীম আহমেদ বলেন, সারাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে রাজশাহীর পরিস্থিতি এখন শান্ত। এখানে আইশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাজশাহীর মানুষ শান্তিপ্রিয়। সরকারের সিদ্ধান্ত মতে আমরা স্থানীয় প্রশাসন ও আইশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সভা করে সিদ্ধান্ত নেব রাজশাহীতে আগামীতে কারফিউর প্রয়োজন আছে কিনা। আমাদের সবার আশা জনজীবন স্বাভাবিক হোক।
সিলেট সোমবার সকাল ৮টার দিকে সিলেট নগরীর শিবগঞ্জ তেরোরতন ও আম্বরখানা এলাকায় কিছুসংখ্যাক দিনমুজুরকে কাজের সন্ধানে বের হতে দেখা যায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ খুঁজছেন তারা।
তেরোরতন এলাকার বাসিন্দা রফিক মিয়া বলেন, ৮-১০ দিন ধরে গন্ডগোল হচ্ছে। কোনো কাজ নেই, ঘরে খাবারও নেই। পেট তো আর কারফিউ বোঝে না। তাই পেটের জ্বালায় কাজ খুঁজতে বাধ্য হয়ে ঘরে থেকে বের হয়েছি।
কারফিউর চতুর্থ দিন সোমবার সিলেটের আইনশৃঙ্খলা পরিস্তিতি শান্ত রয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের সহিংসতা হয়নি। বিক্ষিপ্তভাবে রিকশা, অটোরিকশা চলছে। টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের গাড়ি। শুধু ওষুধের দোকান ছাড়া বিপণিবিতান ও দোকানপাট সবকিছু বন্ধ রয়েছে। এতে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। রাজপথে আন্দোলনকারীদের দেখা যায়নি।
সরেজমিন দেখা যায়, সিলেটের ব্যস্ততম এলাকা জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, আম্বরখানা, চৌহাট্টা, শিবগঞ্জ, তালতলা, কদমতলী, তেলিহাওর, সুবিদবাজার, মদিনা মার্কেট, আখলিমা শেখঘাট, টিলাগড়, মেজরটিলা, উপশহর, লামাবাজার, শাহী ঈদগাহ চৌকিদেখি, মেডিকেল এলাকাসহ নগরীরর পাড়া মহল্লার দোকানপাট খোলেনি। নগরীর বাইরে উপজেলা পর্যায়েও একই চিত্র। সাধারণ বাইরে উপজেলা পর্যায়েও একই চিত্র। সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। শুধু দুপুর ২টা তেকে ৫টা পর্যন্ত কেনাকাটার জন্য পাড়া বা মহল্লার দোকানগুলো খোলে। এসময় ক্রেতাদের ভিড় চোখে পড়ে। ৫টার পর আবার বন্ধ হয়ে যায দোকানগুলো।
এদিকে, শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ কষ্টে দিনযাপন করছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, কোনো ধরনের সহিংসতা নেই স্থিতিশীল রয়েছে। নিয়মিত সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ টহল দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে সিলেটের মহানগর পুলিমের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ বলেন, নগরীতে কোনো ধরনের সহিংসতা হয়নি। পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।