নগদ অর্থ বা তারল্য সংকটে থাকা বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে তহবিল সহায়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর জন্য ‘বিকল্প তহবিল’ গঠনের কথা ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ ওই তহবিল থেকে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদে নগদ অর্থ ধার দেয়া হতে পারে।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে আভাস দেয়া হয়েছে।
ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, গভর্নরের পক্ষ থেকে ব্যাংকের ‘ক্যাশ কাউন্টার’ স্বাভাবিক করার জন্য কত টাকার প্রয়োজন সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকের ঋণ আদায় পরিস্থিতিসহ সংকট উত্তরণে আমরা কী করছি, আরো কী করণীয় রয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা হয়। ব্যাংকগুলোর সংকট কাটাতে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে বলে আভাস দেন গভর্নর। তবে বিকল্পটি কী হবে সে বিষয়ে খোলাসা করা হয়নি।
গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আগে থেকেই এ ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগের অবস্থা নাজুক ছিল। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নতুন টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংককে তারল্যের জোগান দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর অনৈতিক সে প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে ওঠে। আমানত তুলে নিতে বাড়তে থাকে গ্রাহকদের ভিড়। বিপরীতে নতুন করে টাকা জমা না হওয়ায় কিছু ব্যাংকের ‘ক্যাশ কাউন্টার’ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ ব্যাংকগুলো ছাড়াও আগে থেকেই আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল।
সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে এতদিন তারল্য উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংক থেকে ধার দেয়া হচ্ছিল। এ প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ধার দেয়া হয়েছে। তবে আমানতকারীদের চাহিদার বিপরীতে এসব ধার খুবই কম হওয়ায় সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বিকল্প তহবিল গঠনের মাধ্যমে সংকটে থাকা ব্যাংকের পাশে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি সত্ত্বেও তারল্য উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংকগুলো টাকা ধার দিতে গড়িমসি করছে। আবার ধার দেয়ার প্রক্রিয়া ধীর হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর সংকট উত্তরণে তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিশেষ তহবিল গঠনের পরিকল্পনা হচ্ছে। এ তহবিল থেকেই সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দেয়া হবে। বিশেষ তহবিলের অর্থের উৎস কী হবে, সেটি নিয়ে সম্ভাব্য সব বিকল্পের কথা ভাবা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘এ মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলমান রেখেছে। সে আলোচনার ভিত্তিতে কী ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায় সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক বিবেচনা করবে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো বিকল্প পন্থা চূড়ান্ত হয়নি।’
পর্ষদ ভেঙে দেয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তারল্য সংকট চলছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিতে। এ ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী আমানতের অর্থ তুলতে পারছেন না। কিছু ব্যাংকের এটিএম বুথ, আরটিজিএস ও এনপিএসবির মতো সেবা বন্ধ রয়েছে।
গভর্নরের সঙ্গে গতকালের বৈঠকে অংশ নেন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন। জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গভর্নরের পক্ষ থেকে ব্যাংকের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয়ার পর আমরা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছি, সেগুলো জানিয়েছি। আমানতকারীদের আস্থা ফেরতে আরো কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সংকট কাটাতে গভর্নর বিশেষ তহবিল গঠনের আভাস দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা পেলে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
শুরুতে কঠোর অবস্থানে থাকলেও এক মাস ধরে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড় করাতে নানামুখী পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে।
গত ১৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের সব ব্যাংককে রক্ষা করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। পরিচালনায় বদল এনেও যেসব ব্যাংক এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সব আমানতকারীকে রক্ষা করা হবে। আমাদের লক্ষ্য হলো প্রত্যেক আমানতকারীকে সুরক্ষা দেয়া। অনিয়মের মাধ্যমে যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছেন, সেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানকে মরতে দেয়া হবে না। কারণ সব প্রতিষ্ঠান জাতীয় সম্পদ। এর সঙ্গে ব্যাংকের বিনিয়োগ, উৎপাদন ও সরবরাহ জড়িত। সেটি এস আলম হোক কিংবা বেক্সিমকো।’