ডলার সংকটের কারণে অনেক দিন ধরেই দেশের অর্থনীতি চাপে আছে। আর এর মধ্যেই শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। এ আন্দোলন ঘিরে প্রায় মাসব্যাপী (জুলাই) দেশজুড়ে চলছে অস্থিরতা। এসবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম মাসেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের(এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলেছেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারের অর্থসংকট বাড়বে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে অর্থনীতির সব খাত।
রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত অর্থবছরের শেষ হিসাবে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। এত বড় ঘাটতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন অর্থবছরের শুরুতেই রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে এনবিআরের ওপর চাপ বাড়বে। বেকায়দায় পড়বে প্রতিষ্ঠানটি।
সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীদের পক্ষে জুলাই মাসে নিয়মিত শুল্ক, ভ্যাট ও কর কোনোটিই পরিশোধ করা সম্ভব হবে না জানিয়ে এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে এনবিআরের কাছে সময় চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এনবিআর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদন জানানো হয়েছে, কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যবসায়ী-করদাতাসহ সব শ্রেণি পেশা ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধে তাগাদা দিচ্ছে। কিন্তু চলতি মাসে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক কোনো খাতেই রাজস্ব আদায়ে গতিশীলতা নেই। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এই মাসে ঘাটতি এড়ানো কঠিন হবে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, কোটা আন্দোলন ঘিরে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা অর্থনীতির জন্য ভালো হচ্ছে না। ইন্টারনেট বন্ধ। ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ রাখা হয়েছে। বিদেশের সঙ্গে আমরা ব্যবসায়িক যোগাযোগ ও লেনদেন করতে পারছি না। আমদানি রপ্তানিতে স্বাভাবিকতা নেই শিল্প কারখানা বন্ধ। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে রাজস্ব পরিশোধ করবে কীভাবে?
ব্যবসায়ীদের এ শীর্ষ নেতা বলেন, এবারে নাশকতার কারণে আর্থিক ক্ষতি দৈনিক কত তা নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে হিসাব কষা হচ্ছে। এবারে আর্থিক ক্ষতি দৈনিক আট থেকে দশ হাজার কোটি টাকার কম হবে না। শুধু তৈরি পোশাক খাতের দৈনিক আর্থিক ক্ষতি এক হাজার কোটি টাকার মতো হবে। অন্যান্য খাত তো আছেই। এসবের মধ্যে সাধারণ ব্যবসায়ীদের পক্ষে নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। প্রয়োজনে এনবিআরকে তা আমরা জানাব। আরেক ব্যবসায়ী নেতা বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি (বিকেএমইএ) মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদেশ থেকে অর্ডার নিয়ে কাজ শুরু করেছি-এর মধ্যেই কোটা আন্দোলন ঘিরে শুরু হয়েছে বিভিন্ন তৎপরতা। সরকারও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কারফিউ দেয়া হয়েছে। কারখানা বন্ধ। বায়ারদের ঠিক সময়ে পণ্য পাঠাতে পারব না। শুধু আমি না, প্রায় সব রপ্তানিকারকেরই আমার মতো অবস্থা। যেখানে শ্রমিকের মজুরি দিতে পারব না। সেখানে এই মাসের রাজস্ব পরিশোধ করা সম্ভব না। শুধু এই মাসেই না পরের মাসে কী অবস্থা হবে তা নিয়েও চিন্তায় আছি।
দেশের অন্যতম জুতা প্রস্তুকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মঞ্জুর বলেন, এবারের আন্দোলনে সারা দেশে অ্যাপেক্সের প্রায় সব শোরুম বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বেচাকেনা নেই। কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। রাজস্ব পরিশোধ আরো কঠিন।
দেশজুড়ে কারফিউ দেয়া হয়েছে। পাড়ামহল্লায় ও উপজেলা পর্যায়ের কিছু দোকানপাট সীমিত পরিসরে খোলা থাকলেও রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা শহরের বড় বড় শপিংমল, বিপণিবিতান, চেইনশপ বন্ধ। শুধু তাই না ফুটপাতের বেচাকেনাও বন্ধ। শাক-সবজি, মুদি দোকানপাটও আগের স্বাভাবিক সময়ের মতো খোলা রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, এ দেশে প্রায় ৩০ লাখ দোকান আমাদের সমিতির সদস্য। এর বাইরেও দোকান আছে। এদের অর্ধেকের বেশিই ভ্যাটযোগ্য। এবারের এই আন্দোলন ঘিরে যে নাশকতা হয়েছে এ ধরনের ঘটনা আমি আগে কখনো দেখিনি। কারফিউ চলছে। এরমধ্যে সাধারণ মানুষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। অনেক দোকানে বেচাকেনা কমে গিয়েছে। অনেক দোকানে বেচাকেনা নেই। অনেক দোকানি বাধ্য হয়েই দোকান বন্ধ রাখছে। বিক্রি না হলে ভ্যাট দিতে পারব না। এমন পরিস্থিতিতে দোকান মালিকদের ভ্যাট পরিশাধের জন্য চাপ দেয়া ঠিক হবে না।
এলাকার মধ্যে সীমিত পরিসরে পরিবহন চললেও এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চলছে। এতে পণ্য আনা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারখানায় কাঁচামালের সংকট থাকলেও আনতে পারছে না। বন্দরে এসআইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যার ব্যবহার করে বন্দরে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনাকরা হয়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এনবিআর থেকে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে আমদানি রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেও কাজে গতি কমেছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, আগে যে সময়ে ১০০টি আমদানি-রপ্তানি চালান খালাস করা সম্ভব হতো, এখন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ১০টিও সম্ভব হবে না। আন্দোলন ঘিরে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির কারণে দেশের প্রায় সব ধরনের কল-কারখানা বন্ধ।
রাজস্ব বিশেষজ্ঞ এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, এখন দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক নেই। উল্টো অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছে না। এমন সময়ে হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধ করা বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই সম্ভব না। অর্থবছরের প্রথম মাসেই এনবিআরের রাজস্ব ঘাটতি এড়ানো সম্ভব হবে না। এনবিআর আমদানি ও রপ্তানি স্থানীয় পর্যায়ের ভ্যাট এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে রাজস্ব আদায় করে থাকে। গত অর্থবছর এনবিআরকে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করে দিয়েছিল আইএমএফ। অর্থ বিভাগ থেকে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্র দিয়েছিল। এসব লক্ষ্যমাত্রার একটিও পূরণ করতে পারেনি এনবিআর। বিশাল ঘাটতি দিয়ে শেষ হয়েছে সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছর। গত অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায় হয় ৩ লাখ ৭১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। এ সময়ে ঘাটতি হয়েছে ৩৮ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এতে আইএমএফ থেকে অসন্তোষ প্রকাশ করে এনবিআরকে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত ২৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আদায় করতে চাপ দিয়েছে।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ০ দশমিক ৫ শতাংশ হারের বেশি রাজস্ব আদয় করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থবছরের শুরুতেই ধাক্কা খেল এনবিআর।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মো. মির্জ্জা আজিকুল ইসলাম বলেন, ডলার সংকটের কারণে এনবিআর রাজস্ব আদায়ে পিছিয়ে পড়েছে। সরকার অর্থসংকটে আছে। এর মধ্যে সম্প্রতি এই সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে রাজস্ব আদায়ে ধস নামছে।
অর্থবছরের শুরুতেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে না পারলে সরকারি বিভিন্ন খাতে খরচ কমাতে বাধ্য হবে। খরচ কমানোর অংশ হিসেবে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ কমাতে পরলেও বেতনভাতা, ঋণের কিস্তি পরিশোধ, ভর্তুকি-এসব খাতে সরকারের খরচ কমানোর সুযোগ নেই। তাই রাজস্ব ঘাটতি হওয়ায় সরকার বেকায়দায় পড়বে।