ইসরায়েলি দখলদারির পর ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের এখন যে ভূখণ্ড অবশিষ্ট আছে, তা হলো, দখলকৃত পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। গাজায় গত প্রায় আট মাস ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এই সময়ে ৩৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষকে হত্যা করেছে তারা।
এরপরও নরকে পরিণত হওয়া গাজা উপত্যকাজুড়ে ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ও গর্ব প্রকাশ করেছেন। তাঁদের এ আশা আরও ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য এ স্বীকৃতির অর্থ কী—উঠছে সেই প্রশ্ন।
স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে যা করেছে, সেটি কোনো বিদ্যমান রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নয়; বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র (স্বাধীন ফিলিস্তিন) প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার স্বীকৃতিমাত্র। এই পদক্ষেপের ফলে এই তিন দেশ ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ আরও বাড়বে।
স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে যা করেছে, সেটি কোনো বিদ্যমান রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নয়; বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র (স্বাধীন ফিলিস্তিন) প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার স্বীকৃতিমাত্র।
এ পদক্ষেপের ফলে ওই তিন দেশ ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ আরও বাড়বে।
তিন দেশই ঘোষণা করেছে, তারা ফিলিস্তিনকে ১৯৬৭ সালের আগের সীমানার ভিত্তিতে ও পূর্ব জেরুজালেমকে এর রাজধানী ধরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
আয়ারল্যান্ড বলেছে, তারা ডাবলিনে ফিলিস্তিনি মিশন ও ফিলিস্তিনে নিজেদের কার্যালয়কে দূতাবাসে উন্নীত করবে। আর একই রকম পদক্ষেপ আগেই নিয়েছে নরওয়ে ও স্পেন।
মধ্যপ্রাচ্যে একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ অর্জনের একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে যেটিকে সবাই স্বীকার করে, সেদিকে অগ্রসর হওয়ার একমাত্র উপায় এ পদক্ষেপ (ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি)। আর এ সমাধান হলো, ইসরায়েলের পাশে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের উপস্থিতি।
আশার কথা হলো, বাস্তবে না হলেও এর আক্ষরিক স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনের অবস্থান জোরদার করবে। পাশাপাশি, ঠিক এ মুহূর্তে গাজায় যুদ্ধ বন্ধে সমঝোতায় বসার জন্য ইসরায়েলের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে এটি।
তিন দেশের এ স্বীকৃতি একই রকম পদক্ষেপ নিতে এরই মধ্যে স্লোভেনিয়াকে উৎসাহিত করেছে। আগামী ১৩ জুন দেশটি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২৭ জাতির ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য আয়ারল্যান্ড ও স্পেন। আশা করা হচ্ছে, ফিলিস্তিনকে দেশ দুটির স্বীকৃতি ৬ থেকে ৯ জুন ইইউর নির্বাচনকালীন অ্যাজেন্ডায় ফিলিস্তিনের মর্যাদার বিষয়টিকে জোরাল করবে।
তিন দেশের গতকালের স্বীকৃতি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জোরাল এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এ পদক্ষেপ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশগুলোকে আকৃষ্ট করতে পারে।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ অর্জনের একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে যেটিকে সবাই স্বীকার করে, সেদিকে অগ্রসর হওয়ার একমাত্র উপায় এ পদক্ষেপ। আর এ সমাধান হলো, ইসরায়েলের পাশে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের উপস্থিতি।’
বাস্তবিক অর্থে, খুব বড় পরিবর্তন আসে না। তবে ফিলিস্তিনকে আরও বেশি স্বীকৃতি দেওয়ার পথে যেকোনো আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে কোনো সমঝোতার টেবিল বা সম্মেলনে বাড়তি কূটনৈতিক প্রভাব রাখার সুযোগ করে দেয়।
এমনকি ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো দ্বিপক্ষীয় কোনো চুক্তিতে পৌঁছার সক্ষমতা দেয় আন্তর্জাতিক এমন স্বীকৃতি।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০১২ সাল থেকে ‘অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের’ মর্যাদা পেয়ে আসছে ফিলিস্তিন। এতে পরিষদে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করার সুযোগ পেয়ে আসছেন ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিরা।
২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সদস্যপদ নিশ্চিত করেছে ফিলিস্তিন। এর আগে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তার ভূখণ্ডে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ এ আদালতের এখতিয়ার মেনে নেয়।
তবে আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায় ফিলিস্তিনের প্রবেশাধিকার এখনো সীমিত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রবেশাধিকার নেই। যার অর্থ, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বাজেটে ঘাটতি দেখা দিলে ইসরায়েলের মধ্য দিয়ে কোনো চ্যানেলে সহায়তা আসতে হবে। নইলে এ ঘাটতি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকেই মেটাতে হবে। এদিকে হামাস-শাসিত গাজা পুরোপুরি বাইরের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নির্ধারণ করতে পারে শুধু একটি দেশ—ইসরায়েল। কেননা এটি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলকারী শক্তি।
ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন ও জাতিসংঘের আরও ১৪৩টি দেশের আশা, ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ১৯৯০-এর দশকের অসলো চুক্তির প্রতিশ্রুতি পূরণে দেশটিকে বাধ্য করতে পারে। এ চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে সম্মত হয় ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনকে আয়ারল্যান্ড ও স্পেন-ইউরোপের এ দুই দেশ এবং নরওয়ের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ইসরায়েল। তার অভিযোগ, দেশ তিনটি ‘সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত’ করছে।
ওই সিদ্ধান্তে তাৎক্ষণিকভাবে ইসরায়েল আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন থেকে তার রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করে নেয়। তলব করে নিজ দেশে থাকা এসব দেশের রাষ্ট্রদূতকে।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এক বৈঠকে তলব করা রাষ্ট্রদূতদের গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার ফুটেজ দেখান। ফিলিস্তিনকে কেন স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয়, তার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে এই ফুটেজকে ব্যবহারের চেষ্টা করেন তিনি।
অবশ্য, তিন দেশের সরকার ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা এ বার্তা দিয়েছে, ফিলিস্তিনকে তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্য, এতদঞ্চলে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে কাজ করা।