দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারের ঘটনার প্রতি নজর রাখা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই বুধবার দিল্লিতে নিযুক্ত এক শীর্ষ মার্কিন কূটনীতিককে ডেকে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত।
এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছে, বুধবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল দিল্লির মার্কিন দূতাবাসের অন্তর্বর্তীকালীন উপ-প্রধান গ্লোরিয়া বারবেনাকে। প্রায় ৪০ মিনিট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ছিলেন বারবেনা।
এরপরই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র যেভাবে ভারতের একটি আইনি কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করেছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রগুলো একে অন্যের সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর প্রতি সম্মান দেখাবে, এটাই কূটনীতিতে আশা করা হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই দায়িত্বটা আরও বেশি। এর অন্যথা হলে অস্বাস্থ্যকর উদাহরণ তৈরি হয়ে যেতে পারে।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ভারতের আইনি ব্যবস্থাকে অপবাদ দেওয়া সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত।’ এর আগে জার্মানি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতার নিয়ে মন্তব্য করায় ক্ষুব্ধ ও কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি ২১শে মার্চ এক দুর্নীতির মামলায় কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করে। তিনিই ভারতের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি পদে থাকাকালীন গ্রেফতার হয়েছেন। কেজরিওয়াল এখন ইডির হেফাজতে আছেন।
কী বলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি?
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল যে- মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ইমেইলে পাঠানো এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল যাতে সময়-মতো ন্যায্য ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যান, সেটাই কাম্য।’
এর আগে জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেবাস্তিয়ান ফিশার বলেছিলেন অন্য যেকোনো অভিযুক্তের মতোই কেজরিওয়ালেরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতার নিয়ে ওই মন্তব্যের পরেই দিল্লির জার্মান দূতাবাসের উপ-প্রধানকে ডেকে পাঠিয়েছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে ভারতের তরফ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। বলা হয়, ‘এ ধরনের মন্তব্যকে আমাদের আইনি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং আমাদের বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে খাটো করার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখছি’। একই ভাবে মার্কিন শীর্ষ কূটনীতিককে ডেকেও কড়া প্রতিক্রিয়া দিল ভারত।
কেন যুক্তরাষ্ট্র ওই মন্তব্য করল?
ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি– দুই দেশেরই সুসম্পর্ক আছে। বিশেষ করে চীনের ক্রমবর্ধমান বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের কৌশলগত গুরুত্ব বেড়েছে। তার ওপরে ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
এমন একটা সময়ে বন্ধু রাষ্ট্র্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ম অরভিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতার নিয়ে কেন যুক্তরাষ্ট্র মন্তব্য করল, তা অনেক বিশ্লেষককে অবাক করেছে। আবার মন্তব্যটি এমন এক সময়ে করা হল, যখন অরভিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতার নিয়ে মন্তব্য করে জার্মানি আগেই ভারতের কড়া প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েছে!
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরীর কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এরকম মন্তব্য অনভিপ্রেত। তিনি বলেন, ‘ভোটের ঠিক আগে এ ধরনের মন্তব্য অনভিপ্রেত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটাকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলেই মনে করা হবে বা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা।’
বসুরায়চৌধুরী বলেন, ‘অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এটা ভোটের বছর এবং সেখানে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটরা সবসময়েই রিপাবলিকানদের তুলনায় মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলি নিয়ে সরব। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ভোটদাতাদের কাছে একটা বার্তা দেওয়ার হয়তো প্রয়োজন ছিল। সম্ভবত সেজন্যই ভারতের দিক থেকে দেখতে গেলে যেটা অনভিপ্রেত, সেরকমই একটা পদক্ষেপ, একটা মন্তব্য করতে তারা বাধ্য হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘অনেক বিশেষজ্ঞ এরকমটা মনে করছেন ভারতে এখন একটা ‘বি-গণতন্ত্রীকরণ’এর পরিস্থিতি হয়েছে, যে কারণে এখানে গণতন্ত্র অনেক বেশি ক্ষুণ্ণ এরকম মনে করছেন কেউ কেউ। সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই মন্তব্য করেছেন, যেটা আগে কখনও তারা করে নি। যদিও এটাও ঘটনা যে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে ব্যক্তিগত রসায়নও খুব ভাল, তবুও তারা এরকম একটা মন্তব্য করল তাদের নিজেদের দেশের ভোটারদের বার্তা দেওয়ার জন্য।’’
কেন গ্রেফতার কেজরিওয়াল?
দিল্লিতে মদের দোকানের লাইসেন্স দেওয়ার নীতি বদল করে কেজরিওয়াল এবং কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতা মদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন, এই অভিযোগেরই তদন্ত করছে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। এই মামলাতেই কেজরিওয়ালের দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা ও দিল্লির প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীষ শিশোদিয়া এক বছরের বেশি সময় ধরে জেলে আছেন।
দলের সংসদ সদস্য সঞ্জয় সিং ওই একই মামলায় গত বছর অক্টোবর মাসে গ্রেফতার হয়েছেন। অতি সম্প্রতি তেলেঙ্গানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মেয়ে কে কভিতাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন মদ ব্যবসায়ী, নেতা, মন্ত্রী ও তাদের কয়েকজন সহায়কও জেলে রয়েছেন।
দিল্লির আবগারি নীতি সংক্রান্ত ওই মামলায় কেজরিওয়ালকে জেরা করার জন্য নয় বার সমন পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের তদন্ত এজেন্সি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কোনওবারই জেরার মুখোমুখি হননি। তবে আরেক কেন্দ্রীয় এজেন্সি সিবিআই তাকে একবার জেরা করেছিল।
ইডি একটি প্রেস রিলিজ দিয়ে জানিয়েছে যে অরবিন্দ কেজরিওয়ালই এই মামলায় ‘মূল ষড়যন্ত্রকারী’। দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য তেলেঙ্গানার ক্ষমতাসীন দল ভারত রাষ্ট্র সমিতির নেত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মেয়ে কে কভিতা মি. কেজরিওয়াল এবং আপ নেতা মণীষ শিশোদিয়া ও সঞ্জয় সিংয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে ইডি জানিয়েছে।
কথিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এমন একটি নীতি তৈরি করা হয়েছিল যা দক্ষিণ ভারতের একটি মদ লবিকে উপকৃত করেছিল, যাকে ইডি "সাউথ লবি’ বলে অভিহিত করেছে।
তবে এসব অভিযোগ ‘বানোয়াট’ আখ্যা দিয়ে বরাবরই নাকচ করে দিয়ে আম আদমি পার্টি। দলটি বলেছে, আদালতে এর বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের পাশাপাশি অরভিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেই থাকবেন।