বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
 

ভারতের ভিত্তিহীন বিবৃতিতে ঘটনার ভুল উপস্থাপন হয়েছে: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়    চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার নিয়ে বিকৃত তথ্য ছড়াচ্ছে ভারত: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়    অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার, বিচার নিশ্চিতের দাবি হাসনাত ও সারজিসের    চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যা প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা, আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ    একদিনের ব্যবধানে সোনার দাম আরও কমলো    ২০১ রানের বড় হার বাংলাদেশের    চলতি মাসেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু দেড়শ ছাড়িয়েছে   
গাজা-ফিলিস্তিন যুদ্ধ: আমি খুব ভয় পাচ্ছি
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১:২৯ অপরাহ্ন

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বেশ ক্ষীণ কণ্ঠে একজন বলল, ‘ট্যাংকটা আমার পাশেই আছে, ওটা নড়াচড়া করছে।’ ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের কল সেন্টারে বসে থাকা রানা তাঁর নিজের কণ্ঠ শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললেন, ‘এটা কি খুব কাছাকাছি চলে এসেছে?’ ওপাশ থেকে ছোট্ট কণ্ঠে উত্তর এলো, ‘খুব, খুব।’ তারপর কণ্ঠটি আবার বলল, ‘তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাবে? আমি খুব ভয় পাচ্ছি।’ জরুরি কল সেন্টার কর্মী রানা তখন নিজের কণ্ঠস্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করছিল।

কারণ, ফোনে কথা বলছিল গাজার ছয় বছরের এক শিশু। কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া রানার আর কিছুই করার ছিল না। গল্প মনে হলেও সত্য এই ঘটনা বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।  ছয় বছর বয়সী ওই শিশুর নাম ‘হিন্দ রজব’।

 শিশুটি ইসরায়েলি বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাজায় আটকা পড়েছিল। তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিল আত্মীয়দের মৃতদেহ আর হিন্দ রজব লুকিয়ে ছিল চাচার গাড়ির ভেতরে। সাহায্যের জন্য ব্যাকুল হিন্দের কাছে তখন ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের কল সেন্টারের রানাই ছিল একমাত্র পরিচিত জগৎ। শিশু হিন্দ তার চাচা, খালা এবং পাঁচ চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে গাজায় তার বাড়ি থেকে সেদিন রওনা হয়েছিল।

দিনটি ছিল সোমবার (২৯ জানুয়ারি)। ওই দিন সকালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী শহরের পশ্চিমের এলাকায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের উপকূলীয় সড়ক ধরে দক্ষিণে সরে যেতে বলেছিল। হিন্দের মা উইসাম জানান, তাদের এলাকায় তখন তীব্র গোলাগুলি হচ্ছিল। তিনি বলেন,  ‘আমরা আতঙ্কিত হয়ে পালাতে চেয়েছিলাম। আমরা বিমান হামলা থেকে বাঁচতে জায়গায় জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। ’ পরিবারটি শহরের পূর্ব দিকে আহলি হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা ধারণা করেছিল, সেখানে আশ্রয়ের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা।

হিন্দের মা উইসাম এবং তাঁর বড় সন্তান পায়ে হেঁটে সেখানে রওনা হন এবং হিন্দকে তাঁর চাচার গাড়িতে তুলে দেন। উসমান বলেন, ‘এদিন খুব ঠাণ্ডা ছিল, সঙ্গে বৃষ্টিও পড়ছিল। আমি হিন্দকে গাড়িতে যেতে বলেছিলাম, কারণ আমি চাইনি সে বৃষ্টিতে কষ্ট পাক।’ তিনি আরো জানান, গাড়ি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই দিক থেকে বিকট শব্দে গুলির শব্দ শুনেছিলেন। শহরের বিখ্যাত আল-আজহার ইউনিভার্সিটির দিকে যাওয়ার সময় হিন্দের চাচার গাড়িটি অপ্রত্যাশিতভাবে ইসরায়েলি ট্যাংকের মুখোমুখি পড়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য নিকটবর্তী একটি পেট্রল স্টেশনে তারা আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, তখন তারা আটকা পড়েছিল, কারণ চারদিকে আগুন জ্বলছিল।  

গাড়ির ভেতরে থাকা পরিবারটি সাহায্যের জন্য আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করে। তাদের মধ্যে একজন ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের জরুরি সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, যেটি অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকে ৫০ মাইল (৮০ কিলোমিটার) দূরে। পরে আবার রামাল্লার রেড ক্রিসেন্ট কল সেন্টারের কর্মীরা হিন্দের চাচার মোবাইলে ফোন করেন। কিন্তু তখন ১৫ বছর বয়সী মেয়ে লায়ান চাচার পরিবর্তে সাড়া দেয়। সে জানায়, তার বাবা-মা এবং ভাই-বোন সবাই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছে এবং গাড়ির পাশে একটি ইসরায়েলি ট্যাংক রয়েছে। লায়ান আবার জানান, ‘ইসরায়েলি বাহিনী আমাদের দিকে গুলি ছুড়ছে’- এটা বলার পড়েই গুলির শব্দ আর চিৎকার শোনা যায় এবং কথোপকথন সেখানেই শেষ হয়ে যায়।

আবার যখন রেড ক্রিসেন্টের কল সেন্টারের কর্মী রানা ফোন দেন, তখন ফোনটি ধরে হিন্দ। তাঁর কণ্ঠ ছিল খুবই অস্পষ্ট এবং ভয়ে ভরা। পরে রানা বুঝতে পারেন, ওই গাড়িতে একমাত্র হিন্দই বেঁচে আছে। কল সেন্টারের কর্মী তখন তাকে বলেছিলেন, ‘সিটের নিচে লুকাও, কেউ যেন তোমাকে না দেখতে পায়।’ অপারেটর রানা ফকিহ প্রায় এক ঘণ্টা হিন্দের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পেরেছিলেন। আর অন্যদিকে রেড ক্রিসেন্ট ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে তাদের অ্যাম্বুল্যান্সকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য আবেদন করছিল।

রানা তখন কাঁপছিলেন, কষ্ট পাচ্ছিলেন, সাহায্যের হাত এগিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন বলে রানা জানান। তিনি বলেন,  “হিন্দ আমাদের বলেছিল, তার সব আত্মীয় মারা গেছে। কিন্তু পরে সে আবার বলেছিল সবাই ‘ঘুমিয়ে’ পড়েছে।”  রানা বলেন, ‘আমি ওকে বলেছিলাম, ওদের ঘুমাতে দাও, আমরা তাদের বিরক্ত করব না।’  রানা জানান, হিন্দ বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে, কেউ যেন তাকে নিয়ে যায়।

রানা বিবিসিকে জানান, ‘একপর্যায়ে সে আমাকে বলেছিল, সব অন্ধকার হয়ে আসছে, আমার বাড়ি কত দূরে।’ রানা জানায়, ‘এই প্রশ্ন শুনে আমি অবশ হয়ে গিয়েছিলাম এবং খুব অসহায় বোধ করছিলাম।’ এদিকে ইতিমধ্যে রেড ক্রিসেন্ট দল হিন্দের মা উইসামের কাছে পৌঁছে যায় এবং ফোনে হিন্দের সঙ্গে কথা বলানো হয়। মায়ের কথা শুনে সে অনেক বেশি কেঁদেছিল বলে রানা জানান।

হিন্দের মা উইসাম বিবিসিকে বলেন, ‘হিন্দ বারবার বলছিল ফোনটা রেখে দিয়ো না। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে কোথায় ব্যথা পেয়েছে? তারপর আমি তাঁকে কোরআন পড়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছিলাম এবং আমরা একসঙ্গে প্রার্থনা করছিলাম। সে আমার সঙ্গে প্রতিটি শব্দ পুনরাবৃত্তি করেছিল।’

সেদিন অন্ধকার নামার পর অ্যাম্বুল্যান্সচালক ইউসেফ এবং আহমদ জানিয়েছিল, তারা হিন্দের কাছাকাছি চলে এসেছেন এবং ইসরায়েলি বাহিনীর কাছ থেকে  প্রবেশের জন্য অনুমতি নিচ্ছেন। কল সেন্টারে বসে থাকা কর্মীরা এতটুকুই শুনতে পেরেছিলেন, এরপর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের সঙ্গে। হিন্দের দাদা বাহা হামাদা বিবিসিকে বলেছিলেন, মায়ের সঙ্গে হিন্দ অল্প কিছুক্ষণ কথা বলতে পেরেছিল। মা উইসাম শেষে গাড়ির দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন এবং হিন্দ তাঁকে বলেছিল, দূরে অ্যাম্বুল্যান্স দেখতে পাচ্ছে সে। 

উসমান জানান, ‘প্রতি সেকেন্ডে আমার হৃদয় পুড়ে যায়। যতবার আমি অ্যাম্বুল্যান্সের শব্দ শুনি আমার মনে হয়, ওখানে হিন্দ আছে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বন্দুকের গুলি, প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র, প্রতিটি বোমার আওয়াজ শুনলেই মনে হয় আমার মেয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে সেগুলো আর সে আঘাত পেয়েছে। গাজার রেড ক্রিসেন্ট দল বা হিন্দের পরিবার কেউই ঘটনাস্থলে যেতে সক্ষম হয়নি। এলাকাটি এখনো ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ অঞ্চলের ভেতরে রয়েছে। কল অপারেটর রানা বলেন, “রাতের বেলা খুব কষ্ট হয়। ঘুম ভেঙে যায়, হিন্দের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই- ‘আমাকে নিয়ে যাও।’

বিবিসি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে সেদিনের অভিযানের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছিল। নিখোঁজ হিন্দ এবং তাঁকে উদ্ধারের জন্য পাঠানো অ্যাম্বুল্যান্স সম্পর্কেও জানতে চায় বিবিসি। ইসরায়েলি বাহিনী এখনো বলছে তারা ঘটনাটি তদন্ত করছে। 

হিন্দের মা উইসাম বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক বিচার আদালত কোথায়? রাষ্ট্রপতিরা তাদের চেয়ারে বসে আছেন কেন?’ তাঁর মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। উইসাম এখনো অপেক্ষা করে আছেন। দিনের পর দিন আহলি হাসপাতালে অপেক্ষা করে আছেন এই আশায়, হিন্দকে জীবিত ফিরিয়ে আনা হবে।

তিনি বলেন, ‘আমি তাঁর সব জিনিস নিয়ে এসেছি। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি। আমি আমার মেয়ের জন্য প্রত্যেক মুহূর্ত, প্রতিটি সেকেন্ড অপেক্ষা করছি। এই মায়ের কথা কেউ যেন ভুলে না যায়।’

সূত্র : বিবিসি

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আক্তার হোসেন রিন্টু
বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ : প্রকাশক কর্তৃক ৮২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক (৩য় তলা) ওয়্যারলেস মোড়, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।
বার্তা বিভাগ : +8802-58316172. বাণিজ্যিক বিভাগ : +8801868-173008, E-mail: dailyjobabdihi@gmail.com
কপিরাইট © দৈনিক জবাবদিহি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft