
সংস্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবনাগুলোর ওপর অভিন্ন বা কাছাকাছি মতামত তুলে ধরবে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররা। বিএনপির পক্ষ থেকে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে তাদের মধ্যে ইতোমধ্যে আলাপ-আলোচনাও হয়েছে। অবশ্য বিএনপির সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এরই মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক তিনটি দল ঐকমত্য কমিশনে তাদের মতামত জমা দিয়েছে। আজ-কালের মধ্যে না হলে আগামী সপ্তাহে মতামত জমা দিতে পারে বিএনপিসহ বাকি মিত্ররা। সংস্কার ইস্যুতে অভিন্ন বা কাছাকাছি মতামত দিয়ে বিদ্যমান অস্থির পরিস্থিতিতেও ঐক্যবদ্ধ থাকার বার্তা দিতে চায় তারা। বিএনপি ও মিত্রদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ‘রাষ্ট্র সংস্কার করবে নির্বাচিত সংসদ’—দলীয় এমন অবস্থানের ভিত্তিতেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোর জবাব প্রস্তুত করেছে বিএনপি। দলটি তিন বছর আগে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের যে ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছিল, সেটার সঙ্গে মিল রেখেই পাঁচ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর ক্ষেত্রে দলীয় অবস্থান তুলে ধরবে। ঢালাওভাবে মতামত চাওয়া হলেও যেসব সংস্কারের এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই, সেগুলোর ক্ষেত্রে মতামত না-ও দিতে পারে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ এবং কাঠামো তৈরিতে সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে বিএনপি। দলটি মনে করে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে নিজেদের স্বার্থে ও গণতন্ত্রের বিপক্ষে সংবিধানকে একাধিকবার কাটাছেঁড়া করেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থাকেও দলীয়করণ করে ফেলেছিল। তাই আগামীতে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থায় যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে মতামত তুলে ধরবে দলটি। বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অন্য ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে তাদের খুব একটা আপত্তি থাকবে না। তবে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে—এই ধরনের সংস্কার ইস্যুতে একমত হবে না বিএনপি।
এদিকে কমিশনগুলোর সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে দলের অবস্থান চূড়ান্ত করতে কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএনপি। সর্বশেষ গত রোববার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। সেখানে ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার রিপোর্টের ওপর দলীয় প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি সংবিধান সংস্কারের অধিকাংশ প্রস্তাবনার সঙ্গে একমত। তবে দলটির শীর্ষ নেতারা বৈঠকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সংবিধান সংস্কারের এখতিয়ার একমাত্র নির্বাচিত সংসদের। নির্বাচিত সংসদই সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার আনবে। এর বাইরে সরকারের নির্বাচন ও প্রশাসনিক সংস্কারের যে প্রস্তাবনাগুলো রয়েছে, সেগুলোর ওপর জোর দিয়েছেন তারা। প্রশাসনিক সংস্কারের মৌলিক বিষয়গুলোতে একমত পোষণ করেন নেতারা।
জানা গেছে, বিএনপি তাদের এসব সংস্কার প্রস্তাবনা ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়ার পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলন করে জাতির সামনেও তুলে ধরবে। সেখানে কেন এবং কোন কারণে দলীয় এই অবস্থান নিয়েছে, তার ব্যাখ্যা তুলে ধরবে দলটি।
সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে মতামত চেয়ে গত ৬ মার্চ ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে ‘স্প্রেডশিট’ (ছক আকারে) পাঠিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে দলগুলোকে ১৩ মার্চের মধ্যে স্প্রেডশিটে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবের ওপর ‘একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’—এই তিনটি অপশনের যে কোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছিল।
ঐকমত্য কমিশন থেকে চিঠি পাওয়ার পর এটা নিয়ে যুগপতের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বিএনপি। জানা গেছে, কমিশন থেকে গত ১৩ মার্চের মধ্যে মতামত পাঠাতে বলা হলেও একটু সময় নিয়ে ভালোভাবে কাজটি শেষ করতে চায় বিএনপি। এক সপ্তাহ ধরে সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে দলটি। মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শের পাশাপাশি দল ও দলের বাইরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলে দলীয় মতামত প্রস্তুত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোর ওপর আমাদের দলীয় মতামত প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে এটা নিয়ে পরামর্শ, আলোচনা করা হচ্ছে। যে কোনো দিন সেগুলো কমিশনে জমা দেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্টের ওপর বিস্তারিত মতামত তুলে ধরব। সঙ্গে স্প্রেডশিটটাও থাকবে।
বিএনপি এরই মধ্যে সংস্কারবিষয়ক কয়েকটি ইস্যুতে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না তারা। দলটি মনে করছে, এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কারণ, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর একটি সংবিধান রয়েছে। এই সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে। যে সময়ে দেশে কোনো সংবিধান রচিত থাকে না, মানে একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। দলটি মনে করে, বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সংবিধানকে দলীয়করণ করে গণতন্ত্রের বিপক্ষে এবং নিজেদের পক্ষে সাজিয়েছিলেন। এ কারণে সংবিধানে যে ব্যত্যয় বা বিচ্যুতি হয়েছে, সেজন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক মতৈক্যে সে সংস্কার করবে নির্বাচিত সংসদ।
জানা গেছে, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন ও প্রাদেশিক সরকারের ফর্মুলায় রাজি নয় বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকালে একসঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চাইবে না দলটি। একমত নয় জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও। সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ বছর করার বিষয়েও দলটির আপত্তি থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই টার্মে সীমিত করার বিষয়ে দলটি একমত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে টানা দুবার না থাকার পক্ষে মত ব্যক্ত করা হবে। আইন সভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইন সভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করবে, এই বিধানে রাজি নয় বিএনপি। নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার থাকার বিষয়ে দলটি তাদের ঐকমত্যের কথা জানাবে। নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ, দায়িত্ব ও ক্ষমতা এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্পষ্টীকরণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করার বিষয়ে ইতিবাচক মতামত দেবে বিএনপি।
জানা গেছে, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে গত ১৭ মার্চ যুগপৎ আন্দোলনের শরিক এবি পার্টি এবং ১৩ মার্চ গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও ভাসানী অনুসারী পরিষদ তাদের প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে। অন্য দলগুলো এসব সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে এখন হোমওয়ার্ক করছে। পর্যালোচনা শেষে তারাও তাদের মতামত কমিশনে জমা দেবে।
১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, কমিশনের রিপোর্টগুলো নিয়ে আমরা অনুশীলন-বিশ্লেষণ করছি, কাজ করছি। বিশ্লেষণ শেষে আমরা আমাদের মতামত দেব। আমাদের যে কোনো বক্তব্যে স্বমত অথবা দ্বিমত যাই থাকুক, সেটা শুধু টিক চিহ্ন দিলে হবে না। কেন দ্বিমত বা পক্ষে, সঙ্গে সঙ্গে তার পর্যাপ্ত ব্যাখ্যাও দেওয়া দরকার। স্প্রেডশিটে মতামতের ঘরে ছোট্ট একটু জায়গা রাখা হয়েছে, এটা যথেষ্ট নয়। তাই আমরা স্প্রেডশিটে মন্তব্যের পাশাপাশি পৃথকভাবে লিখিত বিস্তারিত মতামতও তুলে ধরব।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোর ওপর আমাদের মতামতের মন্তব্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই আমরা জাতীয় নির্বাচন চেয়েছি।