শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পর পদত্যাগ করেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। শিগগিরই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। এই কমিশনের অধীনে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
তবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ।
এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছে।
সবার মতামতের ভিত্তিতে এই সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো নির্বাচন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে হবে।
এই সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো নির্বাচনী আইন সংস্কার, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা সংস্কার, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন সংস্কার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, জনপ্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে দলীয়করণমুক্ত করা, নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং প্রার্থীদের তথ্য ফরম তথা হলফনামা ফরমে পরিবর্তন আনা। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার পক্ষ থেকে এসংক্রান্ত সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সংস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনকেও সংস্কার করব।
কমিশনকে যেকোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখব।’ তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে।
এদিকে পদত্যাগের ঘোষণাকালে সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায়, শুধু কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তিবিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, নির্বাচনের প্রতিটি ধাপই সঠিক হওয়া প্রয়োজন। আর প্রতিটি নির্বাচনী ধাপের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে কিছু সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ওপর। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমসুযোগ সৃষ্টি করতে পারে—এমন একটি আইনি কাঠামো থাকতে হবে। ভোটার তালিকা প্রণয়নে যোগ্য সবার ভোটার হওয়া নিশ্চিত করতে হবে। আগ্রহীদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ও ভোটারদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী থাকতে হবে এবং ভোটারদের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীনভাবে ভোটদানের সুযোগ দিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এসব মানদণ্ড পূরণে সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও)-তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য অংশীজনের মতামত নিয়ে একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন করে। যে কমিশনের সদস্য ছিলেন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেড়িয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। ওই কমিশনের প্রস্তাবে শর্ত সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ, প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে তথ্য প্রদানের বিধান এবং রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে বলা হয়। অবশ্য পরে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
ওই সময়ে বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিআই)’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)’ এবং ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)’ নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছে প্রস্তাব জমা দেয়। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশসহ (টিআইবি) বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো পৃথকভাবে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে।
এসব প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে প্রথমে এসংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার মূল আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে একটি বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতামূলক পদ্ধতির পরিবর্তে প্রকৃত গণরায়ের ভিত্তিতে সরকার গঠনের লক্ষ্যে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতির প্রস্তাব এসেছে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতিতে যে দল শতকরা যত ভোট পাবে, আসনও পাবে শতকরা তত ভাগ। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি দলের পুরুষ ও নারী প্রার্থীদের জন্য পৃথক দুটি তালিকা থাকবে। নারী প্রার্থীর সংখ্যা হবে কমপক্ষে মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ। যে দল যতটি আসন পাবে, তার প্রতি তিনজনে একজন হবেন নারী। কোনো দল যদি দুটি আসন পায়, তার একজন হবেন নারী।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতি প্রবর্তন সম্ভব না হলে প্রচলিত নির্বাচনপদ্ধতির কিছু সংস্কার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনোনয়ন বাণিজ্য অবসানের লক্ষ্যে প্রতিটি দলকে প্রতিটি আসনের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তিনজন করে প্রার্থী নির্ধারণ এবং কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড কর্তৃক ওই তিনজনের মধ্য থেকে একজন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। প্রার্থী হওয়ার শর্ত হিসেবে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী ব্যক্তিকে কমপক্ষে তিন বছর আগে সংশ্লিষ্ট দলের সদস্যপদ গ্রহণ করতে হবে। নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ এবং ওই আসনগুলোতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রার্থীদের বর্জনের জন্য ‘না’ ভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে। প্রার্থীদের ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থীদের পোস্টার ছাপানো, হলফনামার তথ্য প্রচার ও আসনভিত্তিক প্রার্থী পরিচিতি সভার আয়োজন করতে হবে। পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন সংশোধন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক ঐকমত্য নিশ্চিত করতে হবে।