১০ মাস আগে আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় ঘূর্ণিঝড় ফ্রেডির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা মাচিঙ্গা। বাস্তুচ্যুত হয় প্রায় ৭ লাখ মানুষ।
কৃষির সঙ্গে জড়িত বহু মানুষকে জীবিকা পরিবর্তন করতে হয়েছে।
মাচিঙ্গার নাজাওয়া এলাকার ২৯ বছর বয়সী গ্রেস (ছদ্মনাম) ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে জানায়, ‘ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় আমাদের সব ফসল ভেসে গেছে। ভুট্টা ও ধান চাষ করতাম আমরা। এবার কিছুই ঘরে তুলতে পারিনি। জীবন বাঁচানোর তাগিদে এবারই প্রথম যৌনকর্মী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছি।’
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, চিউটা নদীর পাড়ে খদ্দের খুঁজছিলেন এই নারী। সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয় গার্ডিয়ানের প্রতিবেদকের সঙ্গে।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এ পেশায় আমি অভ্যস্ত নই। খুব ভয় লাগে। কিন্তু আমার তিনটি সন্তান ও বৃদ্ধ মা–বাবা আমার ওপর নির্ভরশীল বলে এ কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আমার আর উপার্জনের অন্য কোনো পথ নেই।’
গ্রেস এর মতো আফ্রিকার অসংখ্য নারী এখন বাধ্য হয়ে যৌনকর্মীর কাজ করছেন।
গার্ডিয়ান বলছে, এই এলাকার প্রায় ৭০ শতাংশ নারীই কৃষির সঙ্গে জড়িত। তাঁদের কাঁধে থাকে পরিবারের দায়িত্ব। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস ও বন্যায় কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা তাঁদের আগের পেশা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন বেঁচে থাকার স্বার্থে যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাঁরা।
ঘূর্ণিঝড় ফ্রেডির প্রভাব পড়েছে পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাউইয়ের নারীদের ওপরেও। নারীদের যৌন শোষণ ও অধিকার নিয়ে কাজ করে মালাউইয়ের বেসরকারি সংস্থা ‘পিপল সার্ভিং গার্লস অ্যাট রিস্ক’। সংস্থাটির পরিচালক কালেব এনগম্বো বলেন, ‘যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারীরা। এটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ঘূর্ণিঝড় ফ্রেডির পর তানজানিয়ায় যৌনকর্মী নারীর সংখ্যা আগের চেয়ে তিনগুণ বেড়েছে। ২০২২ সালে আমরা ৫৬ জন নারী যৌনকর্মীকে পরামর্শ সেবা দিয়েছিলাম। আর ২০২৩ সালে সেবা দিতে হয়েছে ১৮৭ জন তরুণীকে।’
এনগম্বো আরও জানান, এ পেশায় না আছে নিরাপত্তা, না আছে আর্থিক নিশ্চয়তা। এক রাতের জন্য একজন নারীর ভাগ্যে জোটে মাত্র ২ হাজার কোয়াচা (মালাউয়ের মুদ্রা, যা ৯৫ পাউন্ডের সমান)। আর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জোটে ৫০০ কোয়াচা। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই পুরুষেরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এবং এই সামান্য পারিশ্রমিক থেকেও বঞ্চিত করে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইনসংক্রান্ত ধারণাও বেশির ভাগ নারীর নেই বলে জানান এনগম্বো। ফলে অধিকংশ ক্ষেত্রে নারীরাই ফৌজদারি আইনে হয়রানি ও গ্রেপ্তারের শিকার হন। পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে মামলাই গ্রহণ করে না বলেও অভিযোগ আছে।
নারীদের পেশা পরিবর্তন ও যৌনকর্মে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মালাউইয়ের লিঙ্গ সমতাবিষয়ক মন্ত্রী পলিন কাউডে। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ফ্রেডির পর দারিদ্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যাওয়ায় বহু নারী যৌনকর্মীর পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের অন্যান্য পেশায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার অবকাঠামো ও আবাসন নির্মাণসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে।
মালাউইয়ে ১ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে হাজার হাজার একর কৃষিজমি নষ্ট হয়েছে। ফলে পেশা হারিয়েছেন বহু কৃষিজীবী। সরকার তাদের পেশা পুনরুদ্ধারের চেষ্টার কথা বলছে বটে, তবে তা এতই অপ্রতুল যে বেশির ভাগ নারীর পক্ষে সরকারি সাহায্যের ছায়াতলে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নাতাশা নামের এক যৌনকর্মী বলেন, ‘আমি কোথাও থেকে কোনো সহায়তা পাচ্ছি না; না সরকারি, না বেসরকারি। তাই বাধ্য হয়ে যৌনকর্মী হিসেবে জীবনধারণ করছি।’
তানজানিয়া আর মালাউইয়ের নারীরা যখন বন্যার জন্য ভুগছেন, তখন আফ্রিকার আরেক দেশ কেনিয়াতে খরার কারণে বহু নারী যৌন পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশটির খরাপ্রবণ এলাকায় বসবাসকারী এক নারী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মেট্রোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সুপেয় পানির খুবই অভাব। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটি পানি সংগ্রহকেন্দ্রে যাই। কিন্তু প্রায়ই ওই কেন্দ্রের মালিক আমাকে অসংবেদনশীল প্রস্তাব দেয় এবং আমি রাজি না হলে পানির দাম বাড়িয়ে দেয়। এক পর্যায়ে আমি আমার পরিবারের পানির প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করার জন্য যৌনকর্মে বাধ্য হই।’
কেনিয়া গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরার মুখোমুখি এখন। দেশটিতে হাজার হাজার মা তাদের সন্তানদের মুখে এক আঁজলা পানি তুলে দেওয়ার জন্য যৌনকর্মী হতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, খরার কারণে পূর্ব আফ্রিকায় খাদ্য সঙ্কট এতটাই প্রকট হয়েছে যে অন্তত ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার মধ্যে পড়েছে।
গত দুই বছর ধরে কেনিয়ায় কোনো বৃষ্টি হয়নি। টানা চার মৌসুম কোনো ফসল হয়নি দেশটিতে। মারা গেছে গবাদিপশু, বিনষ্ট হয়েছে কৃষিজমি। এর সঙ্গে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধজনিত জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। এখন একবেলা একমুঠো খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন কেনিয়ার মানুষেরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, কেনিয়ায় প্রতিদিন রান্না, থালাবাসান ধোয়া, পশুপালন ও নিজেদের পান করার জন্য গড়ে ১০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু খরার কারণে পানির উৎস শুকিয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ মানুষ পড়েছে বিপাকে। অল্প কয়েকটি পানি সংগ্রহশালায় দীর্ঘ লাইন তৈরি হচ্ছে।
একজন নারী জানান, তাঁকে অন্তত সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। কোথাও কোথাও আবার পানির উৎস ১৪ কিলোমিটার দূরে। অনেক নারী ও কিশোরী এই দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে পারেন না। তাদেরকে এই পথ পাড়ি দিতে ‘বোডা বোডা’ (মোটরবাইকের মতো এক প্রকার স্থানীয় যানবাহন) ব্যবহার করতে হয়। বেশির ভাগ সময় বোডা বোডার চালকেরা যৌন সুবিধার বিনিময়ে নারীদের এই পথ পার করে দেন। যেসব নারী রাজি হন না, তাদের কাছে উচ্চমূল্যে ভাড়া দাবি করেন।
অনেক নারী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মেট্রোর প্রতিবেদককে বলেছেন, তারা যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে খুব ভোরবেলা দলবেঁধে হেঁটে হেঁটে পানি সংগ্রহ করতে যান।
আফ্রিকায় যৌন নির্যাতনই অবশ্য একমাত্র সমস্যা নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অকাল গর্ভপাত, অযাচিত গর্ভাবস্থা, মূত্রনালীর সংক্রমণসহ যৌনতাবাহিত নানা রোগ।
বৈশ্বিক সংস্থা অ্যাকশন এইড জানিয়েছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের সহায়তা দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সবার আগে প্রয়োজন পানির উৎস বাড়ানো।
কেউ যদি স্বেচ্ছায় যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে নিতে চান, সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু কাউকে জোর করে যৌনকর্মী বানানো উচিত নয় বলে মনে করেন আফ্রিকার মানবাধিকারকর্মী তাকায়তে বোতে। কিন্তু আফ্রিকার নারীরা বাধ্য হচ্ছে যখন বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের টুঁটি চেপে ধরছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের পেছনে দায়ী আসলে জলবায়ু পরিবর্তন। আর জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে দায়ী মানুষ। তাই এসব বন্ধ করতে মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।