গাজীপুর মহানগরীর টিঅ্যান্ডজেড অ্যাপারেলস গ্রুপের পাঁচটি কারখানার ৩ হাজার ৬২০ জন শ্রমিক ও ১২০ জন স্টাফ বকেয়া এক মাসের বেতন নির্ধারিত সময়ের তিন দিন আগেই পেয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁদের অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া হয়।
বেতন পেয়ে কারখানার এক শ্রমিক আলমগীর বলেন, আগামী রোববারের মধ্যে বেতন দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিকাশ অ্যাকাউন্টে বেতন পেয়ে গেছি। আমাদের মালিকপক্ষ কথা দিয়ে কথা রেখেছেন। আমরা সবাই খুশি।
আগামীকাল শনিবার থেকে কারখানাগুলো পুনরায় চালু হবে বলে জানিয়েছেন টিঅ্যান্ডজেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হেদায়াতুল হক। তিনি আশা করছেন, এদিন শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেবেন এবং কারখানার উৎপাদনে অংশ নিয়ে মালিকপক্ষের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সহযোগিতা করবেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, টিঅ্যান্ডজেড গ্রুপের গাজীপুর মহানগরীর মোগরখাল এলাকায় ৫টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার মধ্যে টিঅ্যান্ডজেড অ্যাপারেলস লিমিটেডে শ্রমিকের সংখ্যা ২ হাজার ৮০০ জন, বেসিক ক্লথিং লিমিটেডে ৪২০ জন, অ্যাপারেল আর্ট লিমিটেডে ৪০০ জন শ্রমিক রয়েছেন। এ ছাড়া এক্সপো কার্টুনে ৪০ জন এবং এমএনএস ইয়ার্ন ডায়িংয়ে ৮০ জন স্টাফ রয়েছেন। এসবের মধ্যে প্রথম তিনটিতে শ্রমিকদের অক্টোবর ও সেপ্টেম্বর মাসের বেতন বকেয়া ছিল। আর শেষের দুটিতে স্টাফদের বেতন ও সার্ভিস বেনিফিট বকেয়া ছিল।
গত ৯ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টা থেকে টিঅ্যান্ডজেড গ্রুপের পাঁচটি কারখানার প্রায় ২ হাজার শ্রমিক বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুর মহানগরীর মোঘরখাল এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ভয়াবহ যানজট ছড়িয়ে পড়ে। এ দুটি মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পণ্য পরিবহন। এ আন্দোলন চলে টানা তিন দিন। পরে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান ঘোষণা দেন, শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের দায়িত্ব সরকারের। সরকার শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করবে। পরে মন্ত্রণালয়ে শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার ও মালিকপক্ষের বৈঠক হয়। গত সোমবার রাতে শ্রম ভবনে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে টিঅ্যান্ডজেড গ্রুপের ৩১ জন শ্রমিক প্রতিনিধি, বিজিএমইএর নেতারা এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সর্বসম্মতিক্রমে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সমঝোতায় বলা হয়, ১৭ নভেম্বরের মধ্যে শ্রমিকদের সেপ্টেম্বর মাসের এবং ৩০ নভেম্বর অক্টোবর মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। গ্রুপের কারখানাগুলো কর্তৃপক্ষ দ্রুত খুলে দেবে। এ ছাড়া ৩০ নভেম্বরের আগে কেউ যদি আবার সড়ক অবরোধ করেন, তাহলে টাকা পরিশোধ করা হবে না। পরে শ্রমিকেরা অবরোধ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে সোমবার রাত ১০টার পর থেকে ওই সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।
টিঅ্যান্ডজেড অ্যাপারেলস গ্রুপের চেয়ারম্যান হেদায়তুল হক বলেন, আমরা সরকারের সহায়তায় প্রথম দফায় নির্ধারিত সময়ের আগেই গতকাল বৃহস্পতিবার ৮ কোটি পরিশোধ করেছি। এ টাকা শ্রমিকেরা কোনো কাজ না করেই পেয়েছে। আগামী কিস্তিতে যে টাকা দিব সেটিও তারা কোনো কাজ না করেই পাবে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছি। ব্যাংকে সুদ বাবদ সোয়াশ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করেছি। আমরা কোনো খেলাপি প্রতিষ্ঠান নই। রপ্তানির টাকা সমন্বয় হতে দেরি হওয়ায় আমাদের ওভারডিউ হয়েছে। এ কারণে ব্যাংক থেকে ৮ কোটি টাকার একটি লোন অনুমোদন করানো হয়, যাতে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া যায়। কিন্তু ব্যাংক আমাদের সে টাকাটা দেয়নি। এ কারণে আমরা ঝামেলায় পড়ে গেছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এক্সপোর্ট বিল আপ ফান্ড আছে। সেখান থেকে ১১–১২ কোটি টাকা তুলে শ্রমিকদের বেতন দিতে চেয়েছিলাম। সে টাকাও আমরা পাইনি। তাছাড়া আমাদের আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা দায়িত্ব নিয়ে সহযোগিতা করলে আমাদের এ পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। এসব কারণে আমরা কয়েকবার তারিখ দিয়েও তা রক্ষা করতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে শ্রম সচিব বিদেশ থেকে দেশে ফিরেই তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিয়েছেন’। শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে সহযোগিতা করায় উপদেষ্টাসহ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিকুজ্জামান, অতিরিক্ত সচিব সবুর হোসেন, বিজিএমইএর অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলাম, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীনের কাছ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
টিঅ্যান্ডজেড অ্যাপারেলস গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি প্রায় শত কোটি টাকার বাড়ি ও অন্য স্থাবর সম্পত্তির দলিল নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, কেউ আমাকে দায়িত্ব নিয়ে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু সচিব শফিকুজ্জামান দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।’
শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ বিষয়ে বলেন, ‘শ্রমিকেরা তাদের দাবিকৃত টাকা পেয়েছে। পরের টাকাও তারা সময় মতো পাবে। আমাদের এ সময়ে সরকারের যারা সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই। আগামী দিনেও তাঁদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। আশা করি, শ্রমিকেরা ও সবকিছু বিবেচনা করে কারখানার উন্নয়নে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করবে।’