মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫ ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
 

ভয়ংকর মামলা চক্র
আসামিই চেনেন না বাদী, ফাঁসছেন সাধারণ মানুষ
খন্দকার হানিফ রাজা
প্রকাশ: সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫, ১১:১২ অপরাহ্ন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর গুলশান থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলার বাদী নিজেই স্বীকার করেছেন, এজাহারভুক্ত অধিকাংশ আসামিকে তিনি চেনেন না। এজাহারভুক্ত তিনজন ভুক্তভোগী মামলা থেকে তাদের নাম তুলে নিতে বাদীকে অনুরোধ করেন। বাদী তার নেতার সঙ্গে কথা বলে ৭ দিনের মধ্যে বিষয়টি ফায়সালা করবেন বলে ভুক্তভোগীদের কথা দিয়েছেন। ৭ দিন পর ভুক্তভোগীরা মামলার সেই বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এবার সাফ জানিয়ে দেন, মামলা থেকে নাম তুলে নেবে, কিন্তু বিনিময়ে দিতে হবে ৬ কোটি টাকা। অন্যথায় মামলা থেকে নাম বাদ দেয়া হবে না। জুলাই বিপ্লবের পর মামলা বাণিজ্যের এটি একটি উদাহরণ।

এদিকে, পূর্ব শত্রুতার জেরে নিরীহ মানুষকে মামলায় ফাঁসানোর পর তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে আসামী গ্রেপ্তার করার পর কারাগারে প্রেরণ ও রিমান্ডে আনার ঘটনাও ঘটেছে। 

এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করলেও মুক্তি মিলছে না হয়রানি থেকে গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশে মামলা বাণিজ্যের একটি ভয়ংকর চক্র গড়ে উঠেছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশজুড়ে এ পর্যন্ত হওয়া ঢালাও মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা সম্পর্কে আসামিদের সিংহভাগ কিছুই জানেন না। বাদী চেনেন না আসামিকে, আসামিরাও চেনেন না বাদীকে। 

কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাদী নিজেও ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এছাড়াও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বাদীকে দিয়ে মামলার ভুয়া আসামী বানানোরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য দিয়ে দায়ের করা মামলা থেকে আসামিদের নাম কেটে দিতে মামলাবাজ চক্রের সদস্যরাও দাবি করছে লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত। দেশজুড়ে বর্তমানে ভয়ংকর এ চক্রটি এভাবেই করছে ‘মামলা বাণিজ্য’। আর ‘মামলা বাণিজ্য’ করতে টার্গেট করা হয়েছে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, ব্যাংকার, সরকারি কর্মকর্তাসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষকে আসামি করা হয়। এছাড়াও যাদের সাথে পূর্ব থেকেই শত্রুতা ছিল তাদেরও মোটা অংকের টাকা দিয়ে এ সব মামলায় আসামী বানানো হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও গুলিতে মৃত্যুর ঘটনায় সব চেয়ে বেশি মামলা দায়ের হয়েছে মিরপুর বিভাগের কাফরুল থানা, ভাষানটেক, পল্লবী ও মিরপুর থানায়। এর মধ্যে কাফরুল ও ভাষানটেক থানায় দায়ের করা কয়েকটি মিথ্যা মামলায় ইতোমধ্যে কয়েকজন সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীতে রিমান্ডে আনার ঘটনাও ঘটছে।

জানা যায়, পূর্ব শত্রুতার জেরে মিরপুরের বাসিন্দা গৃহবধূ হেলেনা আক্তারের ঝুট ব্যবসা দখল করে নেয় শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাসের অনুসারি আওয়ামী লীগের নেতা ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এ মান্নান কচির ডান হাতখ্যাত রাজীব চৌধুরী। তিনি এর প্রতিবাদ করায় রাজীব চৌধুরীর সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য হাজী বাপ্পীসহ অন্যান্যদের হাতে একাধিকবার মারধরের শিকার হন। তিনি তার ব্যবসা দখল করে নেয়ার প্রতিবাদ করায় তার উপর নেমে আসে রাজীব চৌধুরীর অত্যাচার ও নির্যাতনের খড়গ। এরই মধ্যে হেলেনাকে কাফরুল থানায় দায়ের করা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগ দায়ের করা মামলায় আসামী বানানো হয়। সে যাতে ছাড়া পেতে না পারেন তাই এজাহারে তাকে বানানো হয়েছে আওয়ামীলীগের নেত্রী। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি কোন দিন আওয়ামীলীগের রাজনীতি করেননি। তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় বিগত ১২/১৩ বছর পূর্বে তার এক দেবরসহ দুইজন গুমের শিকার হন। যাদের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে হত্যা মামলায় আসামী গ্রেপ্তারে সতর্ক থেকে নির্দোষ মানুষকে যেন হয়রানি না করা হয় ও এমন মামলায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে আইন প্রয়োগের নির্দেশ দেন ডিএমপি কমিশনার। কিন্তু তার নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত ৯ এপ্রিল বুধবার দিবাগত রাতে অভিযান চালিয়ে হেলেনাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয় এবং তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তার একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এছাড়াও গত ৬/৭ দিন পূর্বে ভাষানটেক থানায় দায়ের করা একটি মামলায় তাকে মিথ্যা আসামী বানানো হয় বলে জানা যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভয়ংকর এ চক্রের সঙ্গে পুলিশেরও একটি অংশ জড়িত রয়েছে। যারা অন্য কোথায় বদলী না হয়ে বছরের পর বছরযাবত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় চাকুরি করছেন। এছাড়াও ঢাকার এক থানার একটি মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে। তার কাছে মোটা অংকের টাকা চেয়ে না পেয়ে হয়রানির উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার করা ওই কর্মকর্তা জামিনের আবেদন করলেই নতুন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এভাবেই ওই কর্মকর্তাকে একে একে আরও চারটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। অথচ তিনি জানেন না তার কী অপরাধ। মামলাগুলোর বাদীও তাকে চেনেন না বলে জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও মামলার এই ভয়ংকর চক্রের তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রহসনমূলক মামলার কারণে প্রকৃত মামলাগুলো তার মেরিট হারাবে এবং প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিচারব্যবস্থার এক ধরণের আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ইতোমধ্যে অনেক বাদী নিরপরাধ ব্যক্তিদের মামলা থেকে বাদ দিতে আদালতে হলফনামাও দিয়েছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসে পুলিশ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলার তদন্তে উপযুক্ত প্রমাণ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এজাহারনামীয় আসামিকে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। গত ৯ এপ্রিল ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে এ নির্দেশ দেয়া হয়। 

আদেশে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সংক্রান্তে রুজু করা মামলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজাহারনামীয় আসামির সংখ্যা অধিক। এসব মামলার এজাহারনামীয় কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তারের নিমিত্তে উপযুক্ত প্রমাণসহ অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গ্রেপ্তার করতে হবে। এতে আরও বলা হয়, উপযুক্ত প্রমাণ এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত বৈষম্যবিরোধী মামলার এজাহারনামীয় কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

পুলিশের একটি সূত্র জানান, মামলায় কাদের আসামি করা হবে, সেক্ষেত্রে বাদীর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিয়ন্ত্রণ ছিল অন্যদের হাতে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীসহ সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা দিত পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতারা। এখন দেখা যাচ্ছে, হত্যা মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হয়েছে ‘ইচ্ছেমতো’। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, চাঁদাবাজি, পূর্বত্রুতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মামলায় টার্গেট করে আসামি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিজ্ঞানী ড. তৌহিদুল হক জানান, কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকার পরও জুলাই-আগস্টসহ বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হচ্ছে নিরপরাধ ব্যক্তিদের। দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। এটা আইনের মারাত্মক পরিপন্থি। এটা ওই ভুক্তভোগীর মনস্তাত্ত্বিক জগতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এক সময় দেখা যাবে, এসব ভুক্তভোগী প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবেন। এটা সমাজে স্থায়ী নৈরাজ্য এবং অরাজকতার জন্ম দেবে। তদন্তকারী কর্মকর্তার উচিত হবে তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব নিরীহ ব্যক্তিদের মামলা থেকে বাদ দেয়া ও একই সঙ্গে বিষয়টি গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করার কথা জানান তিনি।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আক্তার হোসেন রিন্টু
বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ : প্রকাশক কর্তৃক ৮২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক (৩য় তলা) ওয়্যারলেস মোড়, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।
বার্তা বিভাগ : +8802-58316172, বাণিজ্যিক বিভাগ : +8802-58316175,+8801711443328, E-mail: info@jobabdihi.com , contact@jobabdihi.com
কপিরাইট © দৈনিক জবাবদিহি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft