
মার্চ-এপ্রিলের দুই মাসের অভয়ারণ্যের নিষেধাজ্ঞা, মা-ইলিশ ধরায় অক্টোবরের দুইটি অমাবস্যা-পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা এবং সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য প্রতি বছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাসহ সারা বছর ১৪৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা পালন করতে হয় জেলেদের।
এই নিষেধাজ্ঞায় বোট মালিকেরা নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে টিকে থাকতে পারলেও কর্মহীন হয়ে পড়ে দিনমজুর সাধারণ জেলে।
এছাড়া অন্য কোনো কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় রুটিরুজির জন্য নদীর দিকেই থাকিয়ে থাকতে হয় এসব জেলেদের।
সরেজমিনে উপজেলার মেঘনা উপকূলীয় আলতাফ মাষ্টার ঘাট, পুরাতন বেড়ী ঘাট, হাজীমাড়া ঘাট,রাহুল ঘাট এবং পানির ঘাট ঘুরে দেখা যায়, যেখানে মাস দুয়েক আগে জেলে আর ক্রেতার হাঁক-ডাকে সরব ছিল, ইলিশের নিষেধাজ্ঞায় সে জায়গাগুলো এখন নীরব হয়ে আছে। সাগর থেকে তুলে মাছ ধরার সব ট্রলার এবং সাম্পানগুলো সারিবদ্ধভাবে নোঙর করে রাখা হয়েছে উপকূলে। এদিকে নিষেধাজ্ঞায় মানুষের আনাগোনা না থাকায় ইলিশ মেলাকে ঘিরে গড়ে ওঠা শত শত দোকানপাট বন্ধ হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে।
মাছ ধরার এই দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞায় নিজেদের দুর্দশার কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন পুরান বেড়িবাঁধ ঘাটের ইসমাইল মাঝি। তিনি বলেন, মাছ ধরা নিষেধ। তাই প্রতিদিন বদ্দারদের (বোট মালিক) জাল তুনে (মেরামত) সময় কাটাচ্ছি। সারা দিন জাল তুনে ২০০-৩০০ টাকা পেলেও এই টাকা দিয়ে তো আর সংসার চলে না। সাগরে নামতে পারলে দিনে ১ হাজার থেকে ১,২০০ টাকা পেতাম। কিন্তু এখন যা পাই তা দিয়ে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। আলতাফ মাষ্টার ঘাটের জুবায়ের মাঝি বলেন, আমাদের জীবনটা পিঁপড়ার জীবনের মতো হয়ে গেছে। এক মৌসুমে আয় করে সারা বছর চলতে হয়। মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন নিয়ে ধার-দেনা করে চলতে হয়। আর যখন সাগরে নামতে পারি তখন এসব ধার-দেনা শোধ করতে হয়।
ফারুক নামের এক ট্রলার মালিক বলেন, আমার সাতটি মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে। নদী থেকে তুললে প্রতিটা ট্রলারে কাজ করাতে হয়। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মাঝেমধ্যে গিয়ে আমাদের মাছ ধরার পারগুলো (জায়গা) দেখেশুনে ঠিক করে আসতে হয়। এদিকে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জেলেরা বড় বড় ট্রলার করে এসে আমাদের সীমানা থেকে মাছ মেরে নিয়ে যাচ্ছে।
রাহুল ঘাট কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মেম্বার বলেন, মাছ ধরার এই দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞায় উপকূলের মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। সবাই আড়তদার, মহাজন, ব্যাংক বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে সাগরে মাছ ধরার কাজে লাগায়। এখন দীর্ঘ সময় মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞায় এসব লোন নিয়ে বিপাকে পড়েছে ট্রলার মালিকেরা। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী পুরাতন বেড়ী ও ভৈরবী এলাকার কয়েকশ জেলে পরিবার খুবই কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। চলমান ৬৫ দিনের দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞায় সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক কেজি চালের সহায়তা প্রদান করা হলেও কোনো কোনো জেলের কপালে তাও জোটেনি।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, চলমান নিষেধাজ্ঞায় জেলেদের জীবন নির্বাহের জন্য মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ভিজিএফ (চাল) বিতরণ করা হবে। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে জেলের মধ্যে ৫৫ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। আগামীতে আরো ৩৩ কেজি করে বিতরণ করা হবে। আর অন্যান্য জায়গা থেকে এসে মাছ ধরার বিষয়ে আমি শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে আমি জেলার মিটিং চলাকালে আলোচনা করেছি।