
সময় যত গড়াচ্ছে তত বাড়ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাড়ছে দলগুলোর মাঝে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস আর দূরত্ব।
যার প্রভাব পড়ছে দেশবাসীর ওপরও। নানামুখী অস্থিরতায় কবে আসবে গণতান্ত্রিক সরকার, এই প্রশ্নই এখন সবার মুখে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন যত দেরিতে হবে, রাজনৈতিক সংকট তত বাড়বে। গণতন্ত্র হবে মরীচিকা।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বলা হয়েছিল, প্রথমে সংস্কার, পরে নির্বাচন। তবে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে আগে স্থানীয় নির্বাচন, গণপরিষদ নির্বাচন ও জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার। বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক বা তাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে। অন্যদিকে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো চাচ্ছে আগে জাতীয় নির্বাচন।
বিএনপি যা বলছে
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতিমধ্যে বলেছেন, নির্বাচন বিলম্বিত করার কারণ নেই। এ বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনও হয়েছে এবং স্ট্যাবিলিটি এসেছে। তাই নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, ততই রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হবে।
তিনি আরও বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন নয়। সবার দৃষ্টি জাতীয় নির্বাচনের দিকে। সবকিছু প্রস্তুত, এখন নির্বাচন করতে বেশি সময় লাগবে না। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া, নির্বাচন পেছানোর চিন্তা যুক্তিযুক্ত নয়। একটি দেশে গণতন্ত্র হচ্ছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি ও জামায়াত সবচেয়ে বেশি ফ্যাসিবাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিচার হবে। কিন্তু তড়িঘড়ি করা যাবে না। প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে না পারলে যে যত সংস্কারই ঘোষণা করি না কেন, যে যত নীতি গ্রহণ করি না কেন, কোনোটিই সফল হবে না। রাজনীতি অস্থির হলে প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে এবং অর্থনীতি প্রভাব ফেলবে সবকিছুতে।
এ নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নিজের অবস্থান খোলাখুলি আলোচনা করছেন। তিনি ইতিমধ্যে বলেছেন, জাতীয় নির্বানের আগে স্থানীয় নির্বাচনের কথা বলে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা হচ্ছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনের একটি প্রক্রিয়া জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন। তবে এই ফাঁদে বিএনপি পা দিতে পারে না, পা দেবে না। যত দ্রুত দেশে একটি স্থিতাবস্থা আনা যাবে, তত দ্রুত দেশকে ধ্বংসের কিনারা থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।
জামায়াতের অবস্থান
গত বছরের ২৯ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, আমরা ৪০-এর বেশি সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে ১০টি বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছি। ফলে ন্যূনতম সংস্কার শেষে নির্বাচন দিতে প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি সিলেটে এক সভায় তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন দিলে সেটা হবে নির্বাচনের গণহত্যা। এটা কোনো নির্বাচন হবে না। জামায়াতে ইসলামী সেটা চায় না। নির্বাচনের আগে কিছু মৌলিক সংস্কার হতেই হবে। দেশে একটি গণহত্যা হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিস্থিতি তৈরি হতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কী চায়
দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তার অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়, কিন্তু সেটি সত্য নয়। তবে দেশে এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়, তাই এই অবস্থায় নির্বাচন সম্ভব নয়। তার দল সংবিধানের আমূল সংস্কারের জন্য একটি গণপরিষদ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে, যা বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী গণতন্ত্র নিশ্চিত করবে।
দেশের সামাজিক পরিস্থিতি
রাজনৈতিক এই টানাপোড়েনের মধ্যে দেশের সামাজিক পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। বেড়ে চলছে ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগাতেই অনেক ঘটনা ঘটছে, যার খবর প্রকাশ হচ্ছে গণমাধ্যমে। নারী নির্যাতন, নারী নিগ্রহের ঘটনাও বাড়ছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোও প্রকাশ্যে দাবি দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছে। ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলোর উত্থান নিয়ে যেমন শঙ্কা রয়েছে, তেমনি তৈরি রয়েছে নিরাপত্তাহীনতার সংকট।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, নির্বাচন দ্রুত করার পক্ষে যেমন বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর যুক্তি আছে, তেমনি জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অন্যদেরও সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করার পরে নির্বাচনের যুক্তি আছে। রাজনীতি সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম। আর সামাজিক বিজ্ঞানে যুক্তির শেষ নেই।
তিনি বলেন, গণঅধিকার পরিষদ প্রধান নুরুল হক নুরের কথাই যদি আমরা বলি, আগে তার দল স্থানীয় নির্বাচনের পরে জাতীয় নির্বাচন চেয়েছে। এখন আবার জাতীয় নির্বাচন আগে করার পক্ষে বলছে। তারা হয়তো বর্তমানে ভাবছে, আগে করলে সুবিধা পাবে। তাই সব দল যদি একসঙ্গে আলোচনা করে একটি ঐক্যমতে পৌঁছতে পারে, সেটা ভালো হবে। কেননা, বিএনপির দাবি মেনে আগে জাতীয় নির্বাচন হলে অন্যরা তা মানবে না। অরাজকতা সৃষ্টি হবে। আর বিএনপি বলছে, সংবিধান সংশোধন পার্লামেন্ট ছাড়া হবে না। এনসিপি আবার গণপরিষদ নির্বাচন আগে করার জন্য বলছে। কাজেই যুক্তির অভাব নেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, বিএনপির দাবি মেনে নিয়ে নির্বাচন হলে যে অরাজক পরিস্থিতি আছে সেটা নির্মূল করতে না পারলে আওয়ামী লীগ আন্দোলনের সুযোগ পাবে- অনেকে এমন যুক্তি তুলে ধরছেন। এতে ফ্যাসিবাদের ফের পুনর্বাসন হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের সেনা প্রধানও জাতীয় নির্বাচন আগে করার কথা বলছেন। এটা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার চক্রান্ত কিনা সেটাও হয়তো ভাবছে একটি পক্ষ।
নির্বাচন নিয়ে নানামুখী গেম চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচন না দিয়ে এই সময়টা যত দীর্ঘায়িত হবে, দেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। বেশি দীর্ঘায়িত হলে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি থাকবে না। আবার নির্বাচন দ্রুত হলে বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কন্ট্রোল তারাও করতে পারবে না। আর সুযোগ নেবে আওয়ামী লীগ। কাজেই সব দল মিলে কোনো একটি সিদ্ধান্তে আসতে না পারলে কারো জন্যই ভালো হবে না। চারদিকে সংকট বাড়বে। ফ্যাসিবাদ ফের আসবে।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, প্রথমে সংস্কার, তারপর স্থানীয় নির্বাচন, এরপর গণপরিষদ নির্বাচন, বিচার এবং শেষে জাতীয় নির্বাচন। এভাবে কথাগুলো আসছে। কাজেই জাতীয় নির্বাচন সবার আগে হলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া হবে। গণপরিষদ আগে হতে হবে, তারপর জাতীয় নির্বাচন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল। সেখানে রাজতন্ত্রের যখন অবসান হলো তারা সংবিধান সভা করলো। সেখানে সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর নির্বাচন হলো। আমাদের ৭২ সালে সংবিধান খুব তড়িঘড়ি করো জোড়াতালি দিয়ে প্রণয়ন করা হলো। আমাদের প্রথমেই ভুলটা হয়েছিল। তখন যেভাবে গণপরিষদ হয়েছিল সেটাই ঠিক ছিল না।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য অবশ্যই সময় লাগবে। তবে খুব বেশি দেরিতে নির্বাচন হলে সংকট বাড়বে। এজন্যেই রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। অন্যথায় গণতন্ত্র হবে মরীচিকার মতো। এ থেকে উত্তরণের জন্য দলগুলোর ঐক্যমতে পৌঁছানো ছাড়া উপায় নেই। তবে অবশ্যই গণপরিষদ করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের পর নির্বাচনে যেতে হবে। তাহলেই কেবল প্রকৃত গণতন্ত্র আসবে।
নির্বাচন কমিশনের অবস্থান
রাজনৈতিক এই দুই ধারার মধ্যে না ঢোকার কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন আয়োজনকারী এই সংস্থাটি প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা ডিসেম্বরকেই টার্গেট করে এগিয়ে নিচ্ছে সকল প্রস্তুতি। তবে সংস্কার কার্যক্রমে সরকারের সিদ্ধান্তের দিকেও কিছু কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য তাকিয়ে আছে।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে ভোটার তালিকা হালান গাদের কার্যক্রমে বাড়িবাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ করা হয়েছে। ১৭ লাখের মতো মৃত ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নেওয়া হয়েছে ৫৩ লাখের মতো নতুন ভোটারের তথ্য। বর্তমানে ছবি তুলে নিবন্ধন সম্পন্ন করার কার্যক্রম চলছে।
সরকার থেকে সিদ্ধান্ত এলে সেভাবেই আইন সংশোধন করে সম্পন্ন হবে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কাজ। এছাড়া সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য ইতিমধ্যে আইন সংশোধনের কাজে হাত দিয়েছে সংস্থাটি। সব মিলিয়ে আগামী অক্টোবরে তফসিল ঘোষণার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইসি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রি.জে (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, ছোট পরিসরে স্থানীয় নির্বাচন হয়তো করা যাবে। কিন্তু তাদের প্রস্তুতি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে।
তিনি বলেন, ফুল ফেইজে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে এক বছরের বেশি লেগে যাবে। কাজেই এটা সম্ভব হবে না। ছোট পরিসরে যদি সরকার থেকে নির্দেশনা আসে, সেভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এদিকে এনসিপি থেকে গণপরিষদ নির্বাচনের কথাও বলা হচ্ছে, বিষয়টি উত্থাপন করা হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাজনৈতিক দলেরা তো অনেক কথাই বলেন। আমরা তো ওই রাজনৈতিক বির্তকের মধ্যে যেতে পারবো না। সরকার প্রধান যেখানে একটি টাইম ফ্রেম ঘোষণা করেছেন, হয় আগামী ডিসেম্বর, না হয় ২০২৬ সালের শুরুর দিকে। আমরা ডিসেম্বরকে ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছি। সুতরাং ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই আমাদের চিন্তাভাবনা এখনো পর্যন্ত।
ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন দিতে আরও ছয় মাস সময় লাগলে, তাদের সুপারিশের যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো বাস্তবায়ন করতে তো অনেক সময় লাগবে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরে হবে কি না-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোন ধরনের সুপারিশ আসবে না দেখে তো আমরা বলতে পারবো না। আমরা ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত কোনটা বাস্তবায়নযোগ্য, কোনটা যোগ্য না এটি বলতে পারবো না। আমরা জাতীয় নির্বাচনের জন্য বিদ্যমান যে আইনকানুন আছে সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি।