২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩২ কোটি টাকা। আর ছয় মাসে বেড়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এ তথ্য জানিয়েছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে–বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, নিয়মনীতি সঠিক পরিপালনের কারণে এখন তা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। ফলে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
গভর্নর বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আমি আগেই বলেছিলাম, খেলাপি ঋণ বাড়বে। তবে এখনো খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’ তিনি আশ্বস্ত করেন, ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমকি ২০ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণ ৩ লাখ ৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, এতোদিন খেলাপির একটি বড় অংক গোপন করে রাখা হতো। সব সময় হিসাবের মারপ্যাঁচে সঠিক আড়াল করে প্রকাশ করতো। এখন সঠিক তথ্য প্রকাশ করছে, তাই খেলাপি বাড়ছে। এটা আগামীতে আরও বাড়বে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে কিন্তু কমানোর কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না জানিয়ে ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, এখন খেলাপি ঋণ কমানোর প্রকৃত সময়। এজন্য ঋণ আদায়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আদায় ছাড়া কোনোভাবেই খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে না।
তথ্য অনুযায়ী, তিন মাসে ( ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর প্রান্তিক) খেলাপি ঋণ বলেছে ৬০ লাখ ৭৮৭.৫৫ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২৭ পয়েন্ট বেড়েছে। এর আগে গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের ছিল ৯ শতাংশ। সেই হিসেবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ দশমিক ২০ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণের এতোদিন যারা ডেকে রেখেছেন তাদের ছাড়া দেওয়া ঠিক হবে না পাশাপাশি যারা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না তাদেরকেও ধরতে হবে।
খেলাপিদের বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার করতে হবে জানিয়ে ড. মইনুল বলেন, ঋণ আদায়ের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, সম্পত্তি জব্দ করে প্রয়োজনে তাদের জেলে পাঠাতে হবে। বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার করে দ্রুত মামলার নিস্পত্তি করতে হবে। জামিন অবশ্যই ঋণের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে খেলাপি কমে যাবে।
ডলার সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণের দারস্ত হয় বাংলাদেশ। ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের তিনটি কিস্তি পেয়েছে বাকি চার কিস্তি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ধাপে ধাপে দেবে সংস্থাটি। এর মধ্যে অন্যতম ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে।
সবশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৪২ দশমকি ৮৩ শতাংশ, যা ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ছিল ৪০ দশমকি ৩৫ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকে ১৫ দশমকি ৬০ শতাংশ, যা ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ছিল ১১ দশমকি ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হারও নির্ধারিত মাত্রার অনেক উপরে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে।