রোববার ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০ ফাল্গুন ১৪৩১
 

বসন্তের আগমনের দিনে ভালোবাসা দিবস
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১২:১৫ অপরাহ্ন

আজ পহেলা ফাল্গুন, বাংলার বসন্তের প্রথম দিন। একই সঙ্গে আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসার বসন্ত এসেছে আজ।

প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন যদিও পঞ্জিকার তারিখটি ধরে ঘটে না, তেমনি মানুষের জীবনে ভালোবাসাও আসে না কোনো নির্দিষ্ট দিবস মেনে। তবু বসন্তের প্রতি, ভালোবাসার প্রতি যেন উন্মুখ এ বসুন্ধরা।

শীত তীব্রতা আর কুয়াশার অবগুণ্ঠন সরে এরই মাঝে দখিন দুয়ার থেকে বইতে শুরু করেছে ফাগুনে মৃদুমন্দ হাওয়া। পলাশ-শিমুল ডালে এরই মধ্যে রক্তিম আগুন জ্বলে উঠেছে দিকে দিকে। এ তো ভালোবাসারই আরাধ্য পরিবেশ! কোকিল তাই সঙ্গিনীর প্রণয় আকাঙ্ক্ষায় কুহু কুহু গাইতে শুরু করেছে। মৌমাছিরা মিলন ঘটাচ্ছে ফুলে ফুলে। ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় গভীর গোপনে এ যেন ভালোবাসারই ডাক।

সাধু ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসাকে স্মরণীয় করতে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে প্রায় ১৫ শতাব্দী ধরে। বাংলাদেশে দিবসটি পালনের বয়স যদিও বেশি নয়। তবু বয়স নির্বিশেষে প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসাকে আজ তুমুলভাবে উদযাপন করা হয় সারা দেশে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মাঝে দিনটিকে ঘিরে বিপুল আগ্রহ-উত্তেজনা দেখা যায়।

বিশ্বের বহু দেশে এই ভালোবাসা দিবসটি বহুবিধভাবে উদযাপিত হলেও, বাংলাদেশে বসন্তের উদ্বোধনী দিনে দিবসটি নিঃসন্দেহে অন্যরকম মাত্রায় আবির্ভূত হয়।

একদিকে বাসন্তী সাজ, তারই মধ্যে ভালোবাসায় রাঙানো মন। বসন্তের চেয়ে আর কোনো ঋতুই যেন ভালোবাসার এত যথার্থ ব্যঞ্জনায় অধিষ্ঠিত নয়।

কবি বলেছিলেন, ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’। কিন্তু বাংলার বসন্তে ফুল ফুটেছে। শীতার্ত বৃক্ষের পাতা ঝরে গিয়ে নতুন জীবনের আভাস ফুটে উঠছে ডালে ডালে। মাটির গভীর থেকেও যেন নতুন জীবনের হাতছানি ফাগুনের দুয়ারে দুয়ারে বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথায়, ‘বসন্ত আজ আসলো ধরায়, ফুল ফুটেছে বনে বনে, শীতের হাওয়া পালিয়ে বেড়ায়, ফাল্গুনী মোর মন বনে’। আসলে বসন্ত মানে নতুন প্রাণের কলরব। বসন্তে গাছে গাছে নতুন পাতা আসে। ডালে ডালে কোকিল। রঙিন ফুলে প্রকৃতি সুশোভিত হয়ে ওঠে। এই সময়ে বাতাসে ফুলের রেণু ছড়ায়। নতুন প্রাণের উন্মোচনে প্রকৃতি হয়ে ওঠে বর্ণিল। ভালোবাসা যেভাবে মানুষের মনকে রাঙিয়ে তোলে। ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির সব সদস্যেরই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ঠিক এখানেই ভালোবাসায় বসন্তে একে অপরে মিলে পরস্পর হয়ে ওঠে।

এবার যদি ভাবি ভালোবাসার সংজ্ঞা কী, তা দেশে দেশে যুগে যুগে নানা সমাজে নানানভাবে নির্ণয় করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু প্রেম বা ভালোবাসা কী, তা জানার আগে থেকেই মানুষ, বিশেষভাবে বললে নর-নারী একে অপরের প্রণয়ে আবদ্ধ হয়েছে। জৈবিক ও চেতনাগত অনুরণন প্রকৃতির নিয়মেই অবধারিতভাবে ডেকে এনেছে তাদের কাছে। এদিক দিয়ে ভালোবাসতে লাগে না কোনো দিবস কিংবা মৌসুম। তবু বসন্ত মানব-মানবীর চিরায়ত প্রণয়ের আবহ সংগীত রচনার ভার নিয়েছে পৃথিবীর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে।

মানব-মানবীর ভালোবাসা তাই অবধারিতভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে শিল্প সাহিত্যে। বহু যুগলের প্রণয়োপাখ্যানও সেইসঙ্গে স্মরণীয় হয়েছে যুগের পর যুগ।

ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু, রোমিয়-জুলিয়েট, চণ্ডিদাস-রজকিনী থেকে শুরু করে আমাদের মৈমনসিংহ-গীতিকার মহুয়া, মলুয়া, কাজল রেখা কিংবা দেওয়ান-মদিনার প্রেম কাহিনিতে দেশকালভেদে নরনারী প্রেমের বিচিত্র আখ্যান উঠে এসেছে।

বসন্তের এই প্রথম দিনে শীতের হিমেল নাজুকতা ভেঙে জেগে উঠেছে প্রকৃতির সমস্ত প্রাণ। দিকে দিকে সেই জাগরণের সাড়া পড়ে গেছে। সারা দেশের মতো এই ডাকাতেও কোকিল তার সুরেলা কুহু কুহু ডাকে প্রণয়ের আহ্বান করতে পিছিয়ে নেই। সমস্ত বছরের স্বপ্ন জমিয়ে সে যেন ভালোবাসার মৌসুমে এসে ঢেলে দিচ্ছে তার প্রেমময় সুর।

ঢাকাসহ সারা দেশে বাসন্তী সাজে খোঁপায় হলদে ফুলের মালা জড়িয়ে পহেলা ফাল্গুন উদযাপন করছে উচ্ছল তরুণীরা। অন্যদিকে প্রেমিক তার কাঙ্ক্ষিত মানবীর জন্য ফুলে ও উপহারে প্রস্তুত। আর এ জায়গাতেই বসন্ত আর ভালোবাসার সংযোগ ঘটে গেছে এই আধুনিককালে।

ঘৃণার বিপরীতে পৃথিবীর প্রাণের পারস্পরিক ঐকান্তিকতার অনন্য অভিজ্ঞতা ভালোবাসা।

ভালোবাসা কী—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বহু মানুষ। যুগে যুগে ভালোবাসার সংজ্ঞা আবিষ্কারের চেষ্টা চলেছে। সখী, ভালোবাসা কারে কয়—এই জিজ্ঞাসা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও করে গেছেন তার গানে। আবার তিনিই লিখেছেন ‘পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,/ মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।’ প্রেমের এমন গভীর অভিব্যক্তি প্রতিটি ভালোবাসায় মগ্ন মানব-মানবীর জীবনে সত্যিইতো কখনো না কখনো আবির্ভূত হয়।

জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন ‘আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’, সেই শান্তি কি ভালোবাসার? কিংবা ‘তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন প্যাঁচার মত প্রাণে’, সেটিই কি মানব-মানবীর ভালোবাসার আবহমান অনুসন্ধানের রূপ?

এমন বিবিধ আলোড়নে, জীবনের কাঙ্ক্ষিত শান্তির পথ ধরে মানুষ তার ভালোবাসার সন্ধান করে গেছে যুগে যুগে।

আবার কেউ কেউ তার ভালোবাসার প্রিয় মানুষকে পাওয়ার আনন্দ দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার বাসনাও ব্যক্ত করেছেন। কবি শামসুর রাহমান যেমন লিখেছেন, ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, আমি তোমার, তুমি আমার’। কিংবা কবি মহাদেব সাহার পঙক্তিতে ফুটে উঠেছে প্রেমের ভিন্ন আরেক গভীর আকুতি—‘করুণা করেও হলেও চিঠি দিও’।

নির্মলেন্দু গুণ লিখলেন, ‘হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুঁই’। এই মন বাড়িয়ে ছোঁয়ার খেলা মনের মাঝে ঘটে আলে নিশিদিন, প্রত্যেক নরনারীর হৃদয়ের গভীর প্রকোষ্ঠে।

আবার ভালোবাসা হারিয়ে প্রিয় মানুষের প্রতি আক্ষেপে কবি নজরুলের মতনও কেউ বলে ওঠেন—‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে’। এক ভালোবাসারই কতরকম রূপ, কত ধরনের পর্যায়। এ সবই মানব-মানবীর প্রেম-ভালোবাসার বিভিন্ন রূপের নানান অনুভব।

ভালোবাসা কী—তা নিয়ে যুক্তিগত কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বৃত্তান্ত বলতে গেলে, ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোনো মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা। সাধারণত, ভালোবাসা বলতে একটি তীব্র আকর্ষণ এবং মানসিক সংযুক্তির অনুভূতিকে বোঝায়। কেন্দ্রীয় মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্বের কারণে, ভালোবাসা সৃজনশীল শিল্পকলার সবচেয়ে সাধারণ বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। ভালোবাসাকে এমন একটি ফাংশন বলা হয়, যা মানুষকে হুমকির বিরুদ্ধে একত্রে রাখে এবং প্রজাতির ধারাবাহিকতাকে সহজতর করে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান ভালোবাসাকে টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে দেখায়। যেটি স্পষ্টভাবে ভেসে উঠতে দেখা যায় বসন্তের প্রকৃতিতেও। গাছে-গাছে, পশু ও পাখিদের জীবনেও।

কিন্তু এত সব যৌক্তিকতা মেনে কেউ কাউকে ভালোবাসে না, কিংবা কোনো মানব-মানবী একে অন্যের প্রেমে পড়ে না এই সব জ্ঞানকাণ্ড অনুসরণ করে। এ মহাবিশ্বের রহস্যময় বিবর্তন প্রক্রিয়ার আবহমান এক সৌন্দর্য, নীরব এক তীব্র আকর্ষণ। আমরা তার অংশ, আমরা তারই জনিত সন্তান।

তাই বসন্তের উদ্বোধনী দিনে ভালোবাসা দিবসের যুগপৎ উদযাপন দারুণ এক তাৎপর্য বহন করে চলেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে এই দিবস পালন খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির মিশ্রণে ভিন্নভাবে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ নামে এটি পালিত হয়।

এই দিনে, বিভিন্ন সম্পর্কের মানুষ প্রেমিক প্রেমিকা, বন্ধু বান্ধবী, স্ত্রী এবং স্বামী, মা এবং সন্তান, ছাত্র এবং শিক্ষক ফুল, চকলেট, কার্ড এবং অন্যান্য জিনিস আদান-প্রদানের মাধ্যমে একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। এই দিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন পার্ক এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলো কানায় কানায় পূর্ণ থাকে।

এই ‘ভালোবাসা দিবস’ পালন করার আয়োজন হিসেবে সামাজিক মাধ্যম খুব বড় একটা ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন ফুলের দোকান, ফ্যাশন হাউস, উপহারের দোকান, বেকারি ও ফাস্ট ফুড দোকানগুলোয় বিশেষ কিছু অফার চালু রাখে। তা ছাড়া টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলগুলোয় ‘ভালোবাসা দিবসের গান’, ‘ভালোবাসা দিবসের নাটক’ ইত্যাদি প্রচারিত হয়।

প্রাণোচ্ছলতার প্রতীক এই ফাগুনে ভালোবাসা হয়ে উঠুক জীবনের অফুরান প্রেরণার উৎস। জীবন সুন্দর হোক। শুভ পহেলা ফাল্গুন ও হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: আক্তার হোসেন রিন্টু
বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ : প্রকাশক কর্তৃক ৮২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক (৩য় তলা) ওয়্যারলেস মোড়, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।
বার্তা বিভাগ : +8802-58316172, বাণিজ্যিক বিভাগ : +8802-58316175,+8801711443328, E-mail: info@jobabdihi.com , contact@jobabdihi.com
কপিরাইট © দৈনিক জবাবদিহি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft