‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০৯’ অনুযায়ী গণভবনকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তাদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন।
ঘন ঘরবাড়ি আর ব্যস্ত জীবনের শহর ঢাকার মধ্যেই সবুজে ভরা, ছায়াঘেরা স্থাপনা ‘গণভবন’কে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে।
জাতীয় সংসদের উত্তর কোণে শেরেবাংলা নগরের প্রাসাদোপম গণভবন নামের বাড়িটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন ছিল। প্রবল গণআন্দোলন ও জনরোষের মুখে গত ৫ অগাস্ট এই বাড়ি থেকেই পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। তারপর জনতার রুদ্ররোষে তছনছ হয় পুরো গণভবন, লুটপাট হয় ভবন ও ভবন এলাকার সব কিছু।
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, গণভবনকে স্মৃতি জাদুঘরে রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, "ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল ও জোট বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সম্পূর্ণ বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজনীতি করতে পারবে কি, পারবে না সেটা জনগণের উপর ছেড়ে দিলাম। তবে আমরা মনে করি কোনো পাবলিক প্রোগ্রাম করার ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা ভাবছি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। এখনও সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়নি। তবে আমরা এটাকে সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করব। বিচার করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় কাজ করছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে তাদের বিচার নিশ্চিত করা হবে।"
‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০৯’ অনুযায়ী গণভবনকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তাদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন।
গণভবনে বসবাসকারী একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সরকারপ্রধান হিসেবে এখানেই বাস করতেন তিনি। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সংস্কারের সম্পন্ন হলে ২০১০ সালে পরিবারসহ গণভবনে ওঠেন শেখ হাসিনা। সেই থেকে ৫ অগাস্ট দুপুরে পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেটিই ছিল তার ঠিকানা।
ক্ষমতার দুই দফাতেই আইন বলে গণভবনকে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার হিসেবে শেখ হাসিনার মালিকানায় নেওয়া হয়। যদিও এটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় হিসেবে তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
গণভবন নামের যথার্থ অনুযায়ী গণের (জনগণের) ভবন হয়ে উঠতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
তিনি বলেন, “আমাদের যে গণভবন আছে, এটা নামের মত ‘গণের ভবন’ হয়ে উঠতে পারেনি। এ দেশের মানুষ, ছাত্র-জনতা একটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এটাকে জয় করেছে। এটাকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জুলাইজুড়ে গণআন্দোলন এবং পরে সরকার পতনের আন্দোলন ঘিরে নজিরবিহীন সহিংসতায় অন্তত এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন বলে অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করে আসছে।
গণভবনে বসে শেখ হাসিনা ছাত্র-নাগরিকের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। যে কারণে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনে ঢুকে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বলে আন্দোলনকারীদের তরফে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি, শহীদদের স্মৃতি এবং বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে যত অন্যায়, অবিচার হয়েছে সব স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার জন্য গণভবনকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে।
“খুব দ্রুতই এর কাজ শুরু হবে। জনগণ যেভাবে বিজয় করেছে, সেই অবস্থাতেই রাখা হবে। এর মধ্যেই ভেতরে একটা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করব। যাতে অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
অগাস্টের শুরুতে সংগঠিত ছাত্র-নাগরিকের এই অভ্যুত্থানে প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। ওই সংঘাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও অর্ধশতাধিক সদস্য নিহত হন।
বৈঠকে জুলাই গণহত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে তুলে ধরে আসিফ মাহমুদ বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সম্মেলন করবেন।”
অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার ২৯ অগাস্ট ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০৯’-কে ‘বৈষম্যমূলক নীতি’ বিবেচনায় আইনটি বাতিল করেছে। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তানদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার সুবিধাটি রহিত হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রস্তাবে ২৯ অগাস্ট উপদেষ্টা পরিষদের চতুর্থ বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত আসার তথ্য দিয়েছিলেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
এ ব্যাপারে সে দিন তিনি বলেছিলেন, “আমাদের এই সরকারটা হচ্ছে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের আউটকাম। নিরাপত্তা সংস্থা এরকম বিশেষ নিরাপত্তার দরকার আছে বলে মনে করে না। আর এটাকে বৈষম্যমূলক মনে করা হয়েছে, সেটার ভিত্তিতে এটা রহিত করা হয়েছে।”
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথাও বলা ছিল ওই নিরাপত্তা আইনে। ওই আইন অনুসারে ২০১৫ সালের মে মাসে বিশেষ নিরাপত্তা এবং সুবিধাদি প্রদানের গেজেট জারি করা হয়।
২৯ অগাস্ট প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, কেবল একটি পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য আইনটি করা হয়েছিল, যা একটি ‘সুস্পষ্ট বৈষম্য’।
“বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব বৈষম্য দূরীকরণে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েছে।”
এর আগে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ছাড়ার আগে 'জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা বিল-২০০১ সংসদ পাস হয়েছিল। তবে বিএনপি নেতৃত্বে চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে অষ্টম সংসদে সেটি বাতিল করে দেয়।
আসিফ মাহমুদ বলেন, পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্টিত টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ ২-০ ব্যবধানে জয় পাওয়ায় ক্রিকেট টিমকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে।
“বন্যা দুর্গতদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে পুনর্বাসন করা হবে। দ্রুত সময়ের মধ্য ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে,” বলেন তিনি।