দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলো আওয়ামী লীগ। এ সময়ে দেশের ব্যাংকিংখাতসহ নানা দুর্নীতির চিত্র বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে তুলে ধরা হলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন মূলহোতারা।
আবার দেখা গেছে কখনও কখনও কিছু রাঘববোয়ালের নাম উঠে এলেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে দেখা যায়নি তাদের।
আমরা দেখেছি এস আলম, তাকসিম এ খান, ভ‚মিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পাহাড় সমান সম্পদের ফিরিস্তি, অতি সাম্প্রতিক পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ অনেক গডফাদারদের মামলা আমলে না নেয়ার নজীর রয়েছে।
বিগত সরকারের আমলে পিয়ন থেকে শুরু করে অফিসের বড় কর্তাদের দুর্নীতির যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিলো তা আমাদের জানা আছে। মহামারি করোনাকালেও দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে উঠে এসেছে। শেয়ার বাজার থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎখাত কোন খাতে দুর্নীতি ছিলো না। আওয়ামী সরকারের সব অর্জন বিসর্জন গেছে শুধু মাত্র দুর্নীতির কারণে। চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে পত্রিকার পাতা, গোলটেবিল বৈঠক, সভা-সমাবেশ, সর্বত্র আমাদের আলোচনার উপাদান এখন ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের বিধ্বস্ত চিত্র! একটি দেশ কি ভাবে চলতে পারে? সত্যিই সংস্কার এখন বড় প্রয়োজন। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের এগিয়ে নিতে হবে স্বপ্নের এ দেশকে।
বিগত সরকার আমাদের চোখে ছানী ফেলে দিয়েছিলো। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড দেশ-বিদেশে অনেক সুনাম অর্জন করছে। চোখে পড়ার মতো ব্যাপক উন্নয়নের রোল মডেলে রূপন্তিত হয়েছে। অথচ এতসব উন্নয়নের আড়ালে কি ঘটেছে তা ধীরে ধীরে এখন উন্মোচিত হচ্ছে।
দেশের সর্ববৃহৎ ও ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি আত্মসাৎ করেছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা-রোসাট্রম মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এ অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দেয়। যাতে মধ্যস্ততা করেন ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় ও ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক। রাশিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণে খরচ ধরা হয় এক হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। প্রয়োজনের তুলনায় যা অনেক বেশি। যাতে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই বাজেট থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা-রোসাট্রম। নিজের ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে এ চুক্তি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ মধ্যস্থতার বিনিময়ে পাচার করা অর্থের ৩০ শতাংশ পেয়েছেন টিউলিপ, শেখ রেহানা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য।
২০১৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাতের সময় সঙ্গী ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। সে সময় ঢাকা-মস্কোর বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তির মধ্যস্থতাও করেন তিনি। ২০০৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া লিমিটেড’ নামে একটি ভুয়া কোম্পানি চালু করেন টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা শেখ রেহানা ও চাচা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক। যুক্তরাষ্ট্রেও জুমানা ইনভেস্টমেন্ট নামে একটি কোম্পানি রয়েছে তাদের। এ কোম্পানির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের অফশোর অ্যাকাউন্টে অর্থপাচার করতেন শেখ হাসিনা।
তাদের এ কোম্পানিটি ডেসটিনি গ্রুপ নামে একটি চিটিং ফান্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প নামে একটি পোর্টালের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। উন্নয়নের নামে বিস্তার ঘটেছে অপরাধী ও দুর্নীতির রাঘব বোয়ালদের। দুর্নীতিবাজরা নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে কোটিপতি বনে যাওয়ার মানসিকতায় বড় বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে দেশকে। সম্প্রতি সাবেক সেনাবাহিনীর প্রধান আজিজ ও পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের অনিয়ম দুর্নীতির খবরে দেশের মানুষের মধ্যে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। রাষ্ট্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দু’জন শীর্ষ পদে থেকে তাদের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ এসেছে তা অত্যন্ত লজ্জার। এরা এতো সম্পাদ গড়ার সুযোগ পেল কী করে? এ প্রশ্ন সাধারণ মানুষের।
এদেশের সমাজব্যবস্থা, চিকিৎসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যে হারে অনিয়ম দুর্নীতি অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে, তাতে যুবসমাজ ছাত্রসমাজ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতি এবং নতুন প্রজন্মকে কিভাবে আলোকিত করবে? একজন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর, তিনি যখন তাঁর মেয়ের সমতুল্য একজন ছাত্রীর সাথে অপকর্মে লিপ্ত হয়। তখন মনে হয় সুশিক্ষার পরিবেশ ক্রমেই কুশিক্ষায় পরিণত হচ্ছে। যখন একজন শিক্ষকের চরিত্র খুবই ন্যাক্কারজনভাবে জাতির সামনে ফুটে উঠে তখন শিক্ষার মানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেশের প্রতিটি সেক্টরে অনিয়ম দেখা যায়।
বিশেষ করে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ব্যাপক হারে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ আছে। বড় বড় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা নানান ধরনের অপরাধ প্রকাশ পাচ্ছে পত্র-পত্রিকায়। এদেশে বাস করে ১৮ কোটির অধিক মানুষ আজ তাকিয়ে আছে একটি উজ্জল আগামীর দিকে। মানুষ খুঁজছে একজন জনতার নেতা। আগামীর বাংলাদেশ হবে একটি দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ। আর সেই স্বপ্নে দেশ গড়তে হলে আইনের শাসনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ব্যক্তি, কবি লেখক সাংবাদিক সুশীলদের নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন করতে হবে। সকল অনিয়ম দুর্নীতি ও সামাজিক সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তরুণ-যুব সমাজ যে ভাবে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে এসছে আমরা থাকবো তাদের পাশে। গড়ব এক নতুন বাংলাদেশ। তবেই স্বার্থক হবে শহীদ আবু সাঈদ মুগ্ধদের আত্মত্যাগ