শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, আরও পাঁচটি ব্যাংক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ইচ্ছেমতো লুট করে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে সদ্য বিদায়ী আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। ঋণের নামে পাচার করা এই টাকা ব্যাংকে ফেরত না আসায় ব্যাংকগুলো দেড় বছর ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না। কিন্তু সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিশেষ সুবিধা দিয়ে এসব ব্যাংকের কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখেছিলেন। এখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব সুবিধা কাটছাঁট করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকায় নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ‘টাকা ছাপিয়ে’ ও নানা অভিনব সুবিধা দিয়ে এস আলম-নিয়ন্ত্রিত ছয়টি ব্যাংককে টিকিয়ে রেখেছিলেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এতে তৎকালীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সায় ছিল। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান সাবেক গভর্নর। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংককে দেয়া বিশেষ সুবিধার সীমা কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি এসব ব্যাংকের এক কোটি টাকার বেশি অর্থের চেক ক্লিয়ারিং করার সুবিধাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
গত বুধবার নতুন গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। এসব ব্যাংক নিয়ে এখন কী করা হবে, সে ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।
এসব ব্যাংকের বিষয়ে এ মুহূর্তে করণীয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, এখন কোনো ব্যাংক আর কৃত্রিমভাবে টিকিয়ে রাখা ঠিক হবে না। যেসব ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেই ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ে স্বাধীনভাবে নিরীক্ষা করাতে হবে। এরপরই ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা থাকলে সহায়তা করা যেতে পারে। না হলে দুর্বল ব্যাংক এভাবে টিকিয়ে রাখলে ভালো ব্যাংকগুলোর অবস্থাও খারাপ হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। এখন ব্যাংকটির এক-তৃতীয়াংশ ঋণই গ্রুপটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট। একই বছরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় দখল করে এস আলম গ্রুপ। আগের বছর তারা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ এস আলম গ্রুপের হাতে। আর ২০০৪ সালে সিকদার গ্রুপ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যায় এস আলম গ্রুপের কাছে।
ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক
২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক)। কিছুদিন পর গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে। এই দুই ব্যাংক যা ঋণ দিয়েছে, তার বেশির ভাগই ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব ঋণ এস আলম গ্রুপের বলেই জানিয়েছেন ব্যাংক দুটির ঋণ বিভাগের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে ইউনিয়ন ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানায়, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে যত ঋণ বিতরণ করেছে, তার সিংহভাগই খেলাপি বা অনিয়মযোগ্য। পরে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এখন ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। ঋণের টাকা আদায় না হওয়ায় ব্যাংকটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। ৭ আগস্ট সিআরআরসহ ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এরপরও ব্যাংকটির লেনদেন নিয়মিত রয়েছে, তবে এখন তা সীমিত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইউনিয়ন ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন আগে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে এত দিন টাকা দিয়ে আসছিল, এখন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে চেক ক্লিয়ার করতে সমস্যা হচ্ছে। আমি চেয়ারম্যান হলেও তেমন কিছু জানি না। আশা করি, দ্রুত ঠিক হয়ে আসবে। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করা দরকার।
ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিণতির দায় আপনার ওপরও বর্তায় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম উদ্দিন বলেন, আমরা প্রতিনিধি পরিচালক, আমাদের হাতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তেমন নেই।
ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের ভাই রাশেদুল আলমসহ পরিবার ও গ্রুপটির কর্মকর্তারা ব্যাংকটির পরিচালক পদে রয়েছেন।
এদিকে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে পি কে হালদার বিভিন্ন নামে টাকা বের করে নেয়ার পর ব্যাংকটি আর খুব একটা ঋণ বিতরণ করেনি। বছরের পর বছর এসব ঋণের কোনো আদায় নেই। প্রতিবছর সুদযুক্ত হয়ে তা শুধু বাড়ছে। গত বছর শেষে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান প্রবাসী নিজাম চৌধুরী, পরিচালক পদে রয়েছেন সাইফুল আলমের ভাই শহীদুল আলম, ভাইয়ের স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজন। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলমও ব্যাংকটির পরিচালক।