গ্রেপ্তার-নির্যাতন সংকট আরও ঘনীভূত করবে জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গতকাল ডাকসুর সাবেক ভিপি, গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হক নুরুকে আদালতে রিমান্ড শেষে নিয়ে আসার সময় গণমাধ্যমে যে চিত্র এসেছে তা যে কোন বিবেকবান মানুষকে আলোড়িত করবে।রিমান্ডে এমনভাবে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে যে তিনি দাঁড়াতেই পারছে না। মধ্যযুগীয় নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে অবৈধ সরকার। কোটা আন্দোলনের অন্যতম তিন সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়েছে। এই ধরনের বর্বরোচিত অমানবিক কাজ পুরো সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব এতথ্য জানানো হয়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বিবৃতিতে আরও বলেন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দ্য মিরর এশিয়ার ঢাকা প্রতিনিধি সাঈদ খানকে গত ২৫ জুলাই গভীর রাতে তাঁর মগবাজারস্থ বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল গ্রেপ্তার করে এবং রাতভর নির্যাতন চালায়। তারপর সাঈদ খানকে মেট্রোরেল পোড়ানোর বানোয়াট মামলায় জড়িয়ে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। কয়েকদিন পূর্বে গুলিবিদ্ধ বাংলাদেশ ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নয়াব আলীর একটি চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, জহিরউদ্দিন স্বপন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ জন জাতীয় নেতা ও অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারান্তরীণ করা হয়েছে। গতকাল যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের বাসায় তল্লাশি করে তাকে না পেয়ে তার ভায়রা, শ্যালক ও শ্যালকের ছেলেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য আবু হানিফকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এছাড়া বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও ইউট্যাবের মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানসহ অসংখ্য মানুষের বাড়ি বাড়ি ডিবি পুলিশ তল্লাশি করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “অবৈধ পন্থায় সরকার ক্ষমতায় আসার পরে অবৈধভাবে ক্ষমতা আগলে রাখার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ ধরে রেখেছে। তার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে হত্যার ঘটনা, সাজানো রায় দিয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দল ও মতের নেতাকর্মীদেরকে মিথ্যা মামলায় সাজা প্রদান, ৫০ লাখ নেতাকর্মীর নামে বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দিয়ে হয়রানি এবং খুন-গুম, রিমান্ডের নামে নির্যাতন অব্যাহত রাখা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকার সৃষ্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে হত্যা-নির্যাতনের পর এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সাজানো মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিরোধী মতের নেতাদেরকে হত্যা, গ্রেপ্তার, গুলি করে আদালতে উঠানোর আগেই নির্যাতন করে পঙ্গু করা হচ্ছে এবং বিচার বিভাগকে দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে আবারো নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সেখানে রিমান্ডের ন্যূনতম আইন মানা হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, গ্রেপ্তারকৃতদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে কল্পকাহিনী রচনা করা হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি এখন কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকেও ব্লক রেড দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, আইডি কার্ড দেখামাত্রই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীদেরকে গুম করে কীভাবে নির্যাতন করে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে তা তাদের শরীরের ক্ষতচিহ্ন দেখলেই অনুধাবন করা যাচ্ছে।”
তারেক রহমানকে নিয়ে সরকারের মিথ্যা প্রচারণার তীব্র নিন্দা জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আরও বলেন, “সরকার প্রথম থেকেই সরকারি গুন্ডাবাহিনীকে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে লেলিয়ে দেয়। তারা এতই রক্তপিপাসু হয়ে গেছে আরও কেন হতাহত ও আরো বেশি রক্তপাত হলো না কেন এর দায় এবং ব্যর্থতায় বিভিন্ন কমিটি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে যা রংপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী নেতাদের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সরকার প্রধানসহ আওয়ামী নেতারা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন, কাল্পনিক কল্পকাহিনী রচনার মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরছে, কিন্তু দেশের জনগণ তা বিশ্বাস করে না।”
বিএনপির এই নেতা বলেন, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে বিপন্ন দেশের মানুষ গত ১৭ বছর যাবত পৈশাচিক নির্যাতন, খুন, গুম, হত্যা, বিচার বহির্ভূত হত্যা এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে এই সরকারের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়েছে। জনগণ সুযোগ পেলেই মাঠে নেমে আসে এবং সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে, নির্বাচনসহ বিভিন্ন সময় জনগণ বারবার সরকারকে বার্তা দিয়েছে পদত্যাগ করার। আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলছে হেলিকপ্টারে থেকে গুলি করা হয় নাই, যদি তাই হয় তাহলে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় শিশু সামির কীভাবে নিহত হলো এই প্রশ্ন দেশবাসীর। ছাত্রদের গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়ার পর তাদের হাসপাতালে দেখতে যাওয়া ও মায়া কান্না এবং সাহায্য করবার কথা বলা জনগণকে প্রতারণা করার আর একটি নজীর। তাই এই সরকারকে বলবো-সকল হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে অবিলম্বে পদত্যাগ করে দেশ এবং দেশের মানুষকে অভিশাপ থেকে মুক্তি দিন। সরকার জনরোষে পড়ার ভয়ে জোর করে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার লক্ষ্যে দেশে কারফিউ দিয়ে রেলসহ সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে রেখেছে, জনগণকে কর্মহীন রেখে অনাহারে দিনাতিপাত করতে বাধ্য করছে, দ্রব্যমূল্য দিন দিন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে জাতি দ্রুত মুক্তি চায়, এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, বর্তমানে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের চেহারা কী বীভৎস রূপ ধারণ করেছে সাংবাদিক নির্যাতন ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে তা ফুটে উঠেছে। সরকারি বাহিনীর হাতে মাত্র এক সপ্তাহে চার সাংবাদিক হত্যা এবং দুই শতাধিক সাংবাদিক আহত হওয়ার ঘটনার বিচার না করে প্রতিবাদী সাংবাদিক নেতা সাঈদ খানকে গ্রেপ্তার সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের একটি কু-নজির। কথায় কথায় বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের খুন, গুম, বিনা বিচারে হত্যা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে হত্যা, মিথ্যা ও গায়েবি মামলা, বল প্রয়োগ করে প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সরকার দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতিকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সরকারের প্রতিহিংসা থেকে সাংবাদিকরাও রেহাই পাচ্ছেন না। এ সরকারের আমলে ৬৬ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শত শত সাংবাদিক। অনেক সাংবাদিককে প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তরিত হতে হয়েছে। সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে একটা ভীতির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। আমরা সরকারকে এই ভয়ঙ্কর গ্রেপ্তার খেলা বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।
বিএনপি মহাসচিব বিবৃতিতে সাংবাদিক সাঈদ খানসহ এ পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত বিএনপি ও বিরোধী দলের সকল নেতৃবৃন্দ এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং অবিলম্বে সকলের নিঃশর্ত মুক্তির জোর আহ্বান জানান।