আপিল বিভাগের রায়ের নির্দেশনানুযায়ী সরকারি, আধা সরকারি, স্বয়ত্তশাসিত, আধা স্বয়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন কর্পোরেশনের চাকরিতে-কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের বিধি-১ শাখা হতে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সরকার এই মর্মে আদেশ জারি করিতেছে যে, সমতারনীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্টির প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিৎ করনের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সরকারি, আধা সরকারি, স্বয়ত্তশাসিত, আধা স্বয়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন কর্পোরেশনের চাকরিতে-কর্মে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল গ্রেডে নিম্নরূপভাবে কোটা নির্ধারণ করা হইলো।’
জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারিরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নিয়োগ করা হইবে।’
জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্যপদ সমূহ সাধারণ মেধা তালিকা হইতে পূরণ করা হইবে।’
জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের বিধি-১ শাখা হইতে ২০১৮ সালের ৪ঠা অক্টোবরের পরিপত্রসহ পূর্বে জারিকৃত ও এসংক্রান্ত সকল পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, নির্দেশ, অনুশাসন রহিত করা হইলো।’
জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হইবে।’
গত সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আপিল বিভাগের রায়ের নির্দেশনানুযায়ী কোটা সংস্কার প্রজ্ঞাপন চুড়ান্ত করলে রাতে প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদন দেন। প্রজ্ঞাপনটি জারি হয়। আপিল বিভাগের রায়ের ভিত্তিতে সরকার কোটা নির্ধারণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। ফলে আপিল বিভাগের রায় প্রতিপালন করেই কোটাব্যবস্থায় সংস্কার করা হয়েছে। কোটা সংস্কার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। যা এখনো বহাল আছে। এর মধ্যে গত রোববার সরকারি চাকরির কোটা নিয়ে রায় দেন আপিল বিভাগ। কিন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ বিষয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপন দেখে তাঁরা তাঁদের পরবর্তী অবস্থান জানাবেন।
এদিকে রায়ের পরদিনই সোমবার এ সম্পর্কিত প্রজ্ঞাপন বিষয়ে অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা নতুন নয়, ১৯৭২ সাল থেকে বিভিন্ন হারে কোটা চলে আসছে। সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড আছে। সরাসরি নিয়োগ হয় মূলত ৯ম থেকে ২০তম গ্রেডে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এই অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে ছিল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা। পরে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ। শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনিদের যুক্ত করা হয়।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সব কোটা বাতিল করা হয়। তবে ১৪তম থেকে ২০তম গ্রেডে (মূলত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) কোটা ছিল। যদিও প্রতিষ্ঠান ভেদে এসব পদের কোটায় কিছু ভিন্নতা আছে। অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগও হয় আলাদা নিয়োগবিধিতে।
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে রোববার আপিল বিভাগ যে রায় দেন, তাতে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিত নিয়োগে ৯৩ শতাংশ মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার কথা বলা হয়। বাকি পদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়। তবে রায়ে আদালত বলেছেন, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সরকার চাইলে আদালতের রায় অনুযায়ী পরিবর্তন পরিবর্ধন করতে পারে। বিশেষ করে নারী কোটা একেবারে না উঠিয়ে কিছু পরিমাণ রাখার পক্ষেও কেউ কেউ মত দিচ্ছেন।
অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিযোগ্য বয়সী সন্তান খুব একটা থাকার কথা নয়।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার এখন আদালতের রায়ের বাইরে ভিন্ন কিছু করতে চায়নি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, শিক্ষার্থীদের মূল দাবি পূরণ হলো। এখন সমস্যার সমাধান হবে বলে তাঁরা মনে করেন।