গোটা বিশ্বে জার্মানি এক অনন্য দেশ। একটা সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নরওয়েতে পড়ালেখার জন্য শিক্ষার্থী ছুটতো। এখনো ছুটছে। তবে এসব দেশের পাশাপাশি এখন জার্মানিতেও আগ্রহ বাড়ছে শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিবছর জার্মানে পাড়ি জমান হাজার-হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী। বাংলাদেশিরা তো বটেই। জার্মানিতে দিনকে দিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে।
এর কারণ হলো- জার্মানের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় সেদেশের সরকারের পৃষ্ঠপোশকতায়। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বর্তমানে এ দেশটি শিক্ষার্থীদের কাছে পছন্দের শীর্ষে। আরেকটি বিষয় হলো ব্যাচেলর কোর্স এবং বেশির ভাগ মাস্টার্স কোর্সের জন্য সাধারণত কোনো ফি নেই। কিছু মাস্টার্স প্রোগ্রামে টিউশন ফি থাকলেও তা অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব একটা বেশি নয়। আবার খরচ যে একেবারেই নেই বিষয়টি এমনও নয়। জার্মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে খরচ লাগে যেসব ক্ষেত্রে তারমধ্যে সেমিস্টার কন্ট্রিবিউশন ফি অন্যতম।
অবশ্য এর সঙ্গে আসলে টিউশন ফির কোনো সম্পর্ক নেই। এটি মূলত শিক্ষার্থীদের জন্যই ব্যয় হয়ে থাকে। যেমন- ক্রীড়া-পাবলিক পরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। যদিও এই ফি প্রতিষ্ঠান ভেদে পরিবর্তিত হয়। এই ফি ১০০-৩৫০ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। যাইে হাক মূল আলোচনায় আসা যাক। জার্মানীতে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য ১০টি স্কলারশিপের সুযোগ রয়েছে।
স্কলারশিপগুলো হচ্ছে- জার্মান একাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস স্কলারশিপ। প্রতি বছর ৮০ শতাংশ স্কলারশিপ অফার করে জার্মান একাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস। ফলে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শতাধিক গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের মধ্যে সেসব প্রোগ্রাম শিক্ষার্থীদের কাছে বেশি পরিচিতি পেয়েছে।
স্কলারশিপের আওতায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ডক্টরাল ডিগ্রির পাশাপাশি একাডেমিক কর্মীদের জন্য গ্রুপ গবেষণা ও ভ্রমণ অন্তর্ভুক্ত। তবে স্কলারশিপ ও গ্র্যান্ট আংশিক বা সম্পূর্ণ হবে কি না, তা নির্বাচিত গবেষণার বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
দ্বিতীয়ত রয়েছে ক্যাড জার্মানি রিসার্চ ফেলোশিপ প্রোগ্রাম। অনুন্নত দেশ বা ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের স্নাতক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের জন্য এই স্কলারশিপ দেয়া হয়। আপনি যদি ক্যাথলিক খ্রিষ্টান হন এবং কাজের অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে জার্মানিতে স্নাতকোত্তর বা ডক্টরাল প্রোগ্রাম বা গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যয়ন করতে চান, তাহলে এই স্কলারশিপ বাড়তি সুবিধা দিতে পারে। যেমন-ক্যাড স্কলারশিপ রিটার্ন ফ্লাইট, ভিসা ব্যবস্থা, একাডেমিক টিউশন, বিশ্ববিদ্যালয় ফি, ব্যক্তিগত ফি এবং অন্যান্য অনেক খরচ কভার করে।
তিন নম্বরে রয়েছে- হেনরিক বোল ফাউন্ডেশন স্কলারশিপ। প্রতি বছর জার্মানির হেনরিক বোল ফাউন্ডেশন প্রায় এক হাজার স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ডক্টরাল শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ প্রদান করে। যেকোনো বিষয়ে অধ্যয়নরত বিভিন্ন দেশের ও সংস্কৃতির শিক্ষার্থীরা স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে পারেন। এ ছাড়া, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, ফলিত বিজ্ঞানবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় বা যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা স্কলারশিপের জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হন।
৪র্থ নম্বরে রয়েছে-ইমএমএমআইআর আফ্রিকান-ইউরোপিয়ান স্কলারশিপ। মূলত ইউরোপিয়ান-আফ্রিকান অভিবাসী ও আন্ত:সাংস্কৃতিক সম্পর্কের বিষয়ে মাস্টার্স করতে চাইলে ইরাসমাস মুন্ডাস প্রোগ্রামের স্কলারশিপ পাওয়া যাবে। ইএমএমআইআর স্কলারশিপ আফ্রিকার তিনটি ও জার্মানির একটিসহ মোট চারটি ইউরোপীয় সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। এটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি, ভাতা ও ভ্রমণ ব্যয় সুবিধা দেয়া হয়।
পাঁচ নম্বরে রয়েছে- গ্যোটে গোজ গ্লোবাল মাস্টার্স স্কলারশিপ। জোহানা কোয়ান্ডট ফাউন্ডেশন ফ্রাঙ্কফুর্টের অর্থায়নে গ্যোটে ইউনিভার্সিটি মাস্টার্স স্কলারশিপ প্রোগ্রাম পরিচালিত হয়। ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি জার্মান শিক্ষার্থীরাও এই স্কলারশিপে আবেদন করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ক্যারিয়ারকে সহজতর করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রকল্পগুলোতে অংশগ্রহণ ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করতে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে এটি।
ছয় নম্বরে আছে- ইউনিভার্সিটি অব স্টুটগার্ট স্কলারশিপ। অনগ্রসর দেশের নাগরিক এবং জার্মানিতে পড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয় দুটি মাস্টার্স প্রোগ্রাম- ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্ল্যানিং এবং ইন্টিগ্রেটেড আরবান প্ল্যানিং অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডিজাইন অফার করে। যেকোনো একটিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য দেয়া হবে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ। তবে এজন্য অবশ্যই প্রাসঙ্গিক বৈজ্ঞানিক ও পেশাদার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নতুন জ্ঞান এবং দক্ষতা প্রয়োগ করার সক্ষমতা থাকতে হবে। এই স্কলারশিপে প্রতি মাসে পাওয়া যাবে ৭৫০ ইউরো। প্রোগ্রাম চলাকালীন দেওয়া হবে রাউন্ডট্রিপ পরিবহন খরচ, গবেষণা বৃত্তি, ভাড়া পরিশোধ বৃত্তি এবং স্বাস্থ্য বীমা।
সপ্তম স্থানে রয়েছে- জ্যাকবস ইউনিভার্সিটি ডাইভারসিটি স্কলারশিপ। জ্যাকবস ইউনিভার্সিটি (বর্তমানে কনস্ট্রাকটর ইউনিভার্সিটি) শ্রেণীকক্ষের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রতি বছর সারাবিশ্বের শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানায়। স্কলারশিপ প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা দুই বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং তিন বছরের স্নাতক ডিগ্রির জন্য অর্থ সহায়তা পাবেন। তবে এর মধ্যে প্রতি শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৬ হাজার ইউরো খাওয়া আর আবাসন বাবদ খরচ হতে পারে। এছাড়াও প্রতি শিক্ষাবর্ষে ৬৫০ ইউরো নিয়মিত টিউশন ফি’র অন্তর্ভুক্ত নয়। অষ্টম নম্বরে রয়েছে- হ্যামবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস স্কলারশিপ। হ্যামবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস প্রতি বছর স্নাতক কোর্সে নথিভুক্ত বিশ্বের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দেয়। হ্যামবুর্গ শহর বর্তমানে হ্যামবুর্গ প্রতিষ্ঠানের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সে অর্থায়ন করায় দেশীয় ও ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দিতে হয় না। এ ছাড়া, কোর্স চলাকালীন স্কলারশিপের অধীনে প্রতি মাসে ৪০০ ইউরো পর্যন্ত উপার্জন করার অনুমতি দেয়া হয়।
নবম স্থানে রয়েছে- হকস্কুল হফের বাভারিয়ান সরকারি স্কলারশিপ। জার্মান একাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস এবং বাভারিয়ান সরকার যৌথভাবে হকস্কুল হফ ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপের জন্য অর্থায়ন করায় গ্রীষ্মকালীন বা শীতকালীন কোর্সে আবেদনকারী ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীরা ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ সুবিধা পান। এজন্য শিক্ষার্থীদের অবশ্যই একটি আর্থিক প্রয়োজনের বিবৃতি জমা দিতে হয়। আর্থিক শংসাপত্রের ওপর ভিত্তি করে স্কলারশিপ দেয়া হলেও এটি প্রতি মাসে ১০০ থেকে ৬৫৯ ইউরো পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে। যাতে অধ্যয়নরত অবস্থায় আবাসন এবং শিক্ষা খরচ পাওয়া যায়।
আর দশম স্থানে রয়েছে- ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি ইচস্টাট-ইঙ্গোলস্ট্যাড স্কলারশিপ। জার্মানিতে ডক্টরেট বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি স্কলারশিপ বা গ্র্যান্ট অফার করে। যা পেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে আবেদন করতে হবে এবং অধ্যয়ন শুরু করতে হবে। স্কলারশিপ প্রোগ্রাম চলাকালীন আবাসনের জন্য প্রতি মাসে ৩২৪ ইউরো দেয়া হবে। এতে সব টিউশন এবং দৈনিক খরচ কভার হওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।
আসলে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিবেচনায় সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে এই জার্মানি। মূলত জার্মানিকে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রাখার পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে, জার্মানির মোট ১৬টি স্টেটের মধ্যে বাদেন-ইয়ুর্তেমবার্গ বাদে বাকি ১৫টি স্টেটেই উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো টিউশন ফি নেই। পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কেবল আপনার কাছ থেকে প্রতি ছয় মাসে একবার সেমিস্টার ফি নেবে এবং এই ফি-ও বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে সাধারণত ১০০-৩৫০ ইউরোর অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ থেকে ৩৪ হাজার টাকা। কোনোরকম তৃতীয় পক্ষের সাহায্য ছাড়াই একজন শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ নিজের দক্ষতায় কেবল ইন্টারনেটের সহায়তা নিয়েই পুরো আবেদনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। জার্মানির কোন বিশ্ববিদ্যালয়, কোন কোর্স, কোন সেশনে ভর্তির আবেদনপত্র আহ্বান করছে? এসব কোর্সে আবেদনের সময়সীমা ও যোগ্যতাই-বা কী? সব যাচাই-বাছাই করতে দেখতে পারেন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।
সাধারণত জার্মানির ভিসাপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া এবং ভিসা লাভের নিশ্চয়তা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে সহজ এবং কম সময়সাপেক্ষ। জার্মানিতে টিউশন ফি না থাকার কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বৃত্তি পাওয়ার হার কিছুটা কম। তবে নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে ডিএএডি বৃত্তির জন্য আবেদন করা যেতে পারে। জার্মানিতে একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করতে পারেন। এভাবে নিজের এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বও নেয়া সম্ভব।
নিয়মানুযায়ী একজন শিক্ষার্থী বছরে ১২০ দিন পূর্ণ দিবস কিংবা ২৪০ দিন অর্ধদিবস কাজ করতে পারেন। এসব কাজের মধ্যে হোটেল, রেস্তোরাঁ, বারে কাজসহ খাবার পরিবহনের কাজ যেমন রয়েছে; তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রজেক্টে অধ্যাপকের সঙ্গে কাজের সুযোগ আছে যথেষ্ট।
এছাড়া যারা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন তাদের জন্য রয়েছে সুখবর। আপনি জার্মানিতে গেলে শেনজেনভুক্ত ২৬টি দেশে ঘোরার ভিসা পেয়ে যাবেন। জার্মানিতে ডিগ্রি শেষ করার পর ১৮ মাসের একটি ‘জব সার্চিং ভিসা’ দেয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী তাঁর পড়ার বিষয়সংশ্লিষ্ট চাকরি খুঁজে নিতে পারলে জব সার্চিং ভিসা ওয়ার্ক ভিসায় রূপান্তর করা হয়। দুই বছর চাকরির পর একজন শিক্ষার্থী পিআর বা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারেন। এছাড়াও জার্মানিতে থাকা কিংবা পড়ালেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ভাষা। জার্মানরা নিজেদের ভাষাকে ভীষণ ভালোবাসেন। ইংরেজি জানলেও সাধারণত কেউ অনুরোধ না করলে তারা ইংরেজি বলেন না। ভাষা না জানলে স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে শুরু করে পরে চাকরি-সব ক্ষেত্রেই ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা আছে।
সুতরাং যতই সুবিধা দেওয়া হোক না কেন, জার্মান ভাষা শিখতে না পারলে কিংবা ভাষাটা কঠিন মনে হলে উচ্চশিক্ষার জন্য এই দেশ বেছে না নেয়াই ভালো। বাংলাদেশে বসেই জার্মান ভাষা শেখার যাবতীয় তথ্য পাবেন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।