রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান। তার ব্যবসায়িক ঠিকানা আরাভ জুয়েলার্স, নিউ গোল্ড সুক, দুবাই। গত বছরের শুরুতে নামটি দেশের বহুল আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। দেশের আইনে তিনি একজন পলাতক আসামি। তার অপরাধ, তিনি পুলিশ হত্যা মামলার আসামি। আরাভ খান ভুয়া নাম ও পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট গ্রহণ করেছেন। পাশাপাশি অবৈধ উপায়ে অর্থ নিয়ে দুবাইতে বিনিয়োগ করেছেন।
এক বছরের মাথায় আবারও আলোচনায় আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম। সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন যমুনা টেলিভিশনের দুবাই প্রতিনিধি মেহেদি রুবেল।
গতকাল শনিবার (২২ জুন) দিবাগত রাতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক অনন্য মামুন আয়োজিত ‘বাংলা কার্ণিভাল’ অনুষ্ঠানে এ ঘটনা ঘটে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পুত্র, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক আরশাদ আদনান, বাংলাদেশ কনস্যুলেট দুবাইয়ের কনসাল জেনারেল বি এম জামাল হোসেনসহ বাংলাদেশ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, বিতর্কিত রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের নেতৃত্বে হঠাৎ ৩০-৪০ জনের একটি দল অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকে পড়ে। এ সময় অনুষ্ঠানের আয়োজকরা ও নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের বাধা দেন। এ ঘটনার ভিডিও ধারণ করছিলেন স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা। পরে উত্তেজিত হয়ে কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন আরাভ খান ও তার সহযোগীরা। এতে আহত হন যমুনা টিভির আমিরাত প্রতিনিধি মেহেদী রুবেল। আরও কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী লাঞ্ছিত হন। কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয় তাদের ক্যামেরা ও মোবাইল। একপর্যায়ে অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। আগত অতিথি ও দর্শকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
এ সময় স্থানীয় নাগরিক (লোকাল) আরাভ খানসহ অন্যান্যদের শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানালে তিনি উত্তেজিত হয়ে নিজেকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে দাবি করে বলেন, আমি ভারতীয় নাগরিক। অনুষ্ঠানের মধ্যে আমার অসংখ্য লোকজন, আমাকে ঢুকতে না দিলে সব কিছু পণ্ড করে দেবো।
একপর্যায়ে পুলিশি সহায়তায় তাকে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
জানা যায়, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) স্কুল অব ইন্টেলিজেন্স পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে (৩৪) পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। সেই হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি আরাভ খান।
মামুন হত্যার ঘটনায় তার ভাই বনানী থানায় ২০১৮ সালের ১০ জুলাই একটি মামলা করেন। এই মামলায় ২০১৯ সালে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। সেখানে আরাভের নাম আছে। মামলার এজাহার অনুযায়ী আরাভের আসল নাম রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয়। মামলায় আপনের ঠিকানা গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এ হত্যা মামলার সাজা থেকে বাঁচতে আরাভ এঁকেছিলেন বাংলা সিনেমা আয়নাবাজির ছক। আবু ইউসুফ লিমন নামে এক তরুণকে বিকেএসপিতে খেলার সুযোগের প্রলোভন দেখান আরাভ। এই প্রলোভনে পড়ে লিমন আদালতে আরাভের বদলে আত্মসমর্পণ করেন। পরে আদালত লিমনকে কারাগারে পাঠায়। এই ফাঁকে আরাভ ঊর্ধ্বতন এক সরকারি কর্মকর্তার সহায়তায় নকল পাসপোর্ট বানিয়ে দেশ ত্যাগ করেন। পরে এ বিষয়টি জানাজানি হলে লিমনের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হয়।
উল্লেখ্য, দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খান কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম সোহাগ মোল্লা। তার উত্থানের গল্প বিস্ময়কর। ৩৫ বছর বয়সী আরাভ তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড়। তার বাবা জীবিকার তাগিদে যুবক বয়সে কোটালীপাড়ায় এসেছিলেন। সেখানে সিলভারের হাঁড়ি-পাতিল কাঁধে বহন করে ফেরি করতেন। সংসারের অভাব দেখে ঢাকায় চলে আসে আরাভ।
এরপর মূলত উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারীদের টার্গেট করতে থাকে সে। বিয়ে করেন একাধিক। ৫-৭ জন নারী এলাকায় তার স্ত্রী দাবি করেছিলেন। এ নিয়ে নানা সময়ে সালিশও হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় ১০ বছর আগে আরাভ নিজের টাকায় গ্রামে একটি পাকা ওয়ালের টিনশেড বাড়ি করেন। সেখানে আরাভের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার বাবা-মা বসবাস করতেন। গ্রামের বাড়ি গেলে বড় অংকের অর্থ খরচ করে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করতেন। দুবাইয়ে তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের আগেই একমাত্র ছেলে, বাবা-মা এবং দুই বোনকে সেখানে নিয়ে যায়। বর্তমানে তাদের গ্রামের বাড়ি ফাঁকা। আরাভের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় তার মা এবং দুই বোনকেও আসামি করা হয়।