মেধাবী ও চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। ছিলেন পুলিশের সাবেক আইজিপি। দায়িত্ব পালন করেন এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র্যাব) মহাপরিচালকের। ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারও। এসব দায়িত্ব পালনের সময় অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে। এমন অভিযোগের পর তার সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সত্যতা পেয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি আদালতের দ্বারস্থ হলে বিচারক আদালত বেনজীরের বেশ কয়েকটি ব্যাংক একাউন্ট জব্দের নির্দেশ দেন। এমন আদেশের পর উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন বেনজীরের আইনজীবী। উচ্চ আদালতে গেলে তিনি কি নিস্তার পাবেন? এমন প্রশ্ন অনেকেরই।
আইনজ্ঞরা বলছেন, অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে আইনের দ্বারস্থই হতে হবে বেনজীর আহমেদকে। যথাযথ আদালতে আইনি পথে হাঁটতে পারবেন চাকরিজীবন থেকে নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত সাবেক এই পুলিশ প্রধান।
বেনজীর আহমেদের ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়ে সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আদালতের আদেশে কেউ ক্ষুব্ধ হলে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। যথাযথ ফোরামে যেতে পারেন। তবে আদালত তাকে প্রতিকার দেবে কি না সেটা আদালতের বিষয়। সে হিসেবে বিচারিক আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে বেনজীর আহমেদ হাইকোর্টে যেতে পারবেন। যথাযথ আদালতে আইনী পথে হাঁটতে পারবেন।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আইনগতভাবে জব্দ হওয়া ব্যাংক একাউন্ট খোলার নির্দেশনা চেয়ে লড়াই করতে পারবেন বেনজীর। সেই সুযোগ আইনে আছে। যেসব প্রক্রিয়ায় বেনজীর আহমেদের ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে, সেখানে যদি কোনো ত্রুটি থেকে থাকে তাহলেও তিনি আইনী পদক্ষেপ নিতে পারবেন। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুযায়ী যে প্রক্রিয়ায় মামলা করা হয়েছে, সেখানে কিন্তু ত্রুটিও থাকতে পারে। এসব ত্রুটি দেখে উচ্চ আদালতে পুলিশের সাবেক এই মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
কারও সম্পদ ক্রোক বা অ্যাকাউন্ট জব্দ করার আগে তাকে শোকজ নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু বেনজীরের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। তাই ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়ে নিম্ন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করা হবে।
মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হলেও তিনি কিন্তু তার পেনশনের টাকা পাচ্ছেন। জব্দ হওয়া একাউন্টের বাইরেও বেনজীর সাহেবের অর্থ থাকতে পারে। এজন্য আমি মনে করি তার সংসার খরচ চালাতে কোনো অসুবিধা নেই। কোনো সমস্যা নেই।’
বেনজীর আহমেদের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হকের অভিযোগ, কারও সম্পদ ক্রোক বা অ্যাকাউন্ট জব্দ করার আগে তাকে শোকজ নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু বেনজীরের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। তাই ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়ে নিম্ন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করা হবে।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক এই সম্পাদক বলেন, ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়ে নিম্ন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন বেনজীর আহমেদ। এ ব্যাপারে কাগজপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে।
শাহ মঞ্জুরুল আরও বলেন, ‘বলা হচ্ছে, তার আয়ের সঙ্গে সম্পদ অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু কীভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন, সে ব্যাপারে বেনজীর আহমেদের ব্যাখ্যা থাকতে পারে। আমরা তা শিগগির আদালতকে জানাব।’
বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর শুধু দেশের ভেতরে থাকা তার ব্যাংক একাউন্ট ও সম্পদ জব্দ করেই থেমে থাকছে না দুর্নীতি দমন কমিশন। তার বিরুদ্ধে দেশের বাইরে সম্পদ আছে কি না সেটিও অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। প্রমাণ পেলেই সাবেক এই পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে দুদক।
benjir-2দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান ঢাকা মেইলকে বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়ে আরও অনুসন্ধান চলছে। কমিশন অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানে নতুন কিছু বের হলে তার বিরুদ্ধে আরও মামলা হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান করুক। এরপর আমাদের গাইড করলে আমরা নতুন করে আবেদন করব।
দুদকের আরেক আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করার প্রয়োজন থেকেই তা করা হয়েছে। অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে কমিশন মামলা করবে। মামলার বিচারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তখন এই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রয়োজন হতে পারে। বাজেয়াপ্ত করার সময় যাতে কোনো জটিলতার সৃষ্টি না হয় সেজন্যই জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এখন এই স্থাবর-অস্থাবর সম্পদে কিছুর করার থাকলে তা আদালতের আদেশের মাধ্যমে করতে হবে।’
অনুসন্ধানের পর যদি মামলা করা হয় তবে জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত বহাল থাকবে। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা না মিললে কমিশনই সম্পদ অবমুক্তির জন্য আবেদন করবে বলে জানান এই পাবলিক প্রসিকিউটর।
আদেশ কার্যকরের প্রক্রিয়া জানতে চাইলে মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আদালতের আদেশটি এখন গেজেট আকারে প্রকাশ করবে কমিশন। এরপর দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচার করবে। এ দুটি প্রক্রিয়া ১৫ বা ৩০ দিনের মধ্যে করার বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে।’
আদালতের আদেশটি এরই মধ্যে কমিশনে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আরও বলেন, ‘কমিশন যদি মনে করে জব্দকৃত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রিসিভার নিয়োগ করা দরকার, তবে আদালতে আবেদন করে কমিশনকে রিসিভার নিয়োগ দিতে হবে।’
বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এসব সম্পদ তার এবং তার স্ত্রী এবং তিন সন্তানের নামে নিবন্ধিত।
দুদকের নথি অনুযায়ী, পুলিশ ও র্যাবের প্রধান থাকাকালে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রায় সব জমি কেনেন।
দুদকের নথিতে দেখা যায়, বেনজীর ও তার পরিবার ৮৩টি দলিলের মাধ্যমে ১১৪ একর জমি কিনেছিলেন।
নথি অনুযায়ী, বেনজীর পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে মোট ১১২ একর জমি কিনেছিলেন। আইজিপি থাকাকালে ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫০টি দলিল করে ৬৩ দশমিক ৯৭ একর জমি কেনেন তারা।
এছাড়া র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২৭টি দলিলে ৪৮ দশমিক ১৫ একর জমি কেনেন।
দুদক আরও জানতে পেরেছে, ২০১৪ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার থাকাকালে পাঁচটি দলিলের মাধ্যমে এক দশমিক ৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে তার পরিবার। যার বেশিরভাগ জমি তার স্ত্রী জিসান মির্জার নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল।