প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে উপকূলীয় এলাকায় দমকা হাওয়াসহ প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। পাঁচ থেকে ছয় ফুট জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে ডুবে গেছে উপকূলীয় জেলাগুলোর নিচু এলাকা। তথ্য ও ছবিতে জানিয়েছেন উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রতিনিধিরা।
বাগেরহাটের শরণখোলায় পূর্ব সুন্দরবনে সাগরের পানি ঢুকে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বনের বাঘ ও হরিণসহ অন্যান্য প্রাণী বনের উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। আর বনরক্ষীরা আশ্রয় নিয়েছেন বনবিভাগের রেস্ট হাউস কাম সাইক্লোন সেল্টারে।
সুন্দরবনের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো জানান, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণিকুলের প্রাণহানির শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। দুর্যোগ চলে যাওয়ার পর প্রাণিকুলসহ অন্য ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ওসি আজাদ কবির জানান, দুপুরের পর থেকে দমকা বাতাসের সঙ্গে পানিও বাড়তে শুরু করে। এ কারণে প্রজনন কেন্দ্রে থাকা বন্যপ্রাণী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের দুবলার চর জেলেপল্লি টহল ফাঁড়ির ইনচার্জ ফরেস্ট রেঞ্জার মো. খলিলুর রহমান জানান, বাতাস ও জোয়ারের তোড়ে দুবলা অফিসের জেটি উড়ে গেছে। কয়েকটি ট্রলার স্রোতে ভেসে গেছে। পুকুরের মধ্যে জোয়ারের লবণপানি ঢুকেছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের নীলডুমুর এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। বুড়িগোয়ালিনী, দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা, পদ্মপুকুর, আটুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা খোলপেটুয়া নদী জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে। পানি ঢুকে পড়েছে নীলডুমুর এলাকার বাড়িঘরগুলোতে। এছাড়া জোয়ারের পানির তোড়ে শ্যামনগর ও আশাশুনির বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।
বরগুনায় পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর পানি স্বাভাবিকের থেকে পাঁচ-সাত ফুট পর্যন্ত বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পৌর শহরের নিচু এলাকাসহ ছয় উপজেলার অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ছেন প্রায় তিরিশ হাজার মানুষ। ৬৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্র ও তিনটি মুজিবকেল্লায় প্রায় ৯০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
বরগুনার আমতলীর বালিয়াতলী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে। আমতলী ও তালতলীর ২৭ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া পোটকাখালী, বরইতলা, ডালভাঙ্গা, বাওয়ালকার বাইন চটকি, মাঝেরচর এলাকার চরাঞ্চল অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া উচ্চ জোয়ারের কারণে পায়রা ও বিষখালী নদীর ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর ২০ গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দক্ষিণ চরমোন্তাজ নয়ার চর এলাকায় গ্রাম রক্ষা বাঁধ অতিক্রম করে গ্রামে পানি ঢুকেছে। এতে বাজার, নয়ারচর, দক্ষিণ চরমোন্তাজ, উত্তর চরমোন্তাজ, মোল্লাগ্রাম ও চর আণ্ডাসহ ২০ গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী বৃষ্টি এবং থেমে থেমে বয়ে যায় দমকা বাতাস। উপজেলার আগুনমুখা নদীঘেষা চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রাম ছয় ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় আট হাজার মানুষ।
নোয়াখালীর হাতিয়ায় নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে চার-পাঁচ ফুট জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। এছাড়া বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ডুবেছে নিঝুম দ্বীপের নয়টি গ্রাম । এতে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। পানিতে ভেসে গেছে গবাদিপশুর খাদ্য ও মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে শাকসবজিসহ নানা ফসলের জমি।
ভোলার দক্ষিণে চরফ্যাশনের কুকরীমুকরী, ঢালচর, মুজিবনগর ইউনিয়নসহ ৭৪টি চরাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কুকরীমুকরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন জানান, চর পাতিলার চারদিকে কোনো বেড়িবাঁধ নেই। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এলাকার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ প্লাবিত হয়। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে চরে বুকসমান পানি উঠেছে, এতে চরের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ বন্দি হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের উপকূলীয় এলাকা পতেঙ্গার আকমল আলী সড়কের জেলেপাড়াটি বরাবরের মতো ডুবেছে জোয়ারের পানিতে। এখানকার প্রায় ৩০০ ঘরে জোয়ারের পানি ঢুকে। জেলেপাড়ার সরদার হরিদাস জানান, জোয়ারের পানি ঢুকে সব তলিয়ে যায়। জাল এবং জিনিসপত্র আগেই সরিয়ে নেওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে ঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কক্সবাজারে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে সদর উপজেলার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরাটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর নুনিয়াছটাসহ অন্তত ২১টি গ্রাম। কক্সবাজারের মহেশখালীর চারটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
পিরোজপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় পানির উচ্চতা দুই থেকে আড়াই ফুট পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তুলনামূলক নিচু এলাকার ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগরে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে ১৩টি বসতবাড়ি। রোববার বিকেলে স্বাভাবিকের তুলনায় পানির উচ্চতা বাড়লে উপজেলার কলবাড়ী জেলেপাড়া তলিয়ে যায়।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে উপকূলীয় রক্ষা বাঁধে দেখা দিয়েছে ভাঙন। উত্তাল কচা নদীর সাঈদখালী এলাকার সাঈদখালী বাজারের পূর্ব পাশের বেড়িবাঁধে এ ভাঙন দেখা দেয়।
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলার চারদিকে মেঘনা ও তার শাখা নদী। হিজলার চরাঞ্চল দুই-তিন ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে দুই থেকে আড়াই ফুট উঁচু দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বৈদ্যুতিক খুঁটিতে গাছ পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপের চারপাশে সাগরের পানির উচ্চতা আগের চেয়ে ৪-৫ ফুট বেড়েছে। বাঁধ না থাকায় দ্বীপ দুটিতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের সোরা এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ রক্ষায় নির্মিত রিং বাঁধটি ভেঙে গেছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গতকাল বিকেল থেকেই উপকূলের নদী, খালে পানি বাড়তে শুরু করে। রাত ১১টা পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। এছাড়া দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিতে উপকূলীয় অঞ্চলের নদনদী উত্তাল হয়ে ওঠে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপের পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে।