মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
 

ভারতের ভিত্তিহীন বিবৃতিতে ঘটনার ভুল উপস্থাপন হয়েছে: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়    চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার নিয়ে বিকৃত তথ্য ছড়াচ্ছে ভারত: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়    অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার, বিচার নিশ্চিতের দাবি হাসনাত ও সারজিসের    চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যা প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা, আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ    একদিনের ব্যবধানে সোনার দাম আরও কমলো    ২০১ রানের বড় হার বাংলাদেশের    চলতি মাসেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু দেড়শ ছাড়িয়েছে   
ব্যাংক একীভূতকরণে সরিষার ভূত
মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান:
প্রকাশ: সোমবার, ৬ মে, ২০২৪, ৮:৪৫ অপরাহ্ন

দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে সবল ব্যাংকের একীভূতকরণ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ব্যাংকগুলো মার্জার বা একীভূত হলে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে, আবার সঠিক প্রক্রিয়ায় একীভূত না হলে অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সব মিলিয়ে তালগোল পাকাচ্ছে। ফলে ধোঁয়াশা যেন সহসায় কাটছে না এ খাতের। তবে পরিস্থিতির আলোকে আশা-দূর আশায় বলা চলে এ যেন ব্যাংক একীভূতকরণে সরিষার ভূত দেখতে পাচ্ছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।

তাদের মতে, আমাদের দেশে এমনিতেই ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা উচিত। একীভূত হলে ব্যাংকের সংখ্যা কমে আসবে। তবে একীভূতকরণে রয়েছে অনেক সমস্যা। আমানতকারীদের আমানত কোন প্রক্রিয়ায় হেফাজতে থাকবে, শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার কিভাবে বন্টন হবে?, যারা ঋণখেলাপি তারা পার পেয়ে যাবে কি-না?, এরকম অনেক জটিলতা রয়েছে। এসব জটিলতার সমাধান না করে তারাহুরা করে ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণ করা ঠিক হবে না। আর এসব জটিলতার সমাধান করতে গিয়ে আদৌ শেষ পর্যন্ত ব্যাংকগুলো একীভূত হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

তারা বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণের যে ভুত বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘাড়ে চেপেছে, তা অর্থনীতির জন্য কতটুকু শুভকর হবে তা সময়েই বলে দেবে। তবে ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে ঋণখেলাপিদের পার পেয়ে যাওয়া। ঋণ খেলাপীদের থেকে অর্থ আদায় না করতে পারলে ও তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে না পারলে ব্যাংক একীভূত করে কোনো লাভ হবে না। আর ব্যাংক একীভূতকরণ একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। খুব সহজেই একীভূত করা যাবে না।

অর্থনীতিবিদরা জানান, খেলাপি ঋণ পুরো অর্থনীতির শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিচ্ছে। এই সমস্যা চিহ্নিত। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের প্রধান সমস্যা পুঁজি পাচার ও খেলাপি ঋণ। পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে বিদেশে মুদ্রা পাচার করছে। আর পণ্যের দাম কম দেখিয়ে দেশকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। বিশেষ করে প্রত্যেক ব্যাংকের ইচ্ছাকৃত শীর্ষ ঋণখেলাপিকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তার আগে গঠন করতে হবে ঋণখেলাপি ট্রাইব্যুনাল। যেখানে কোনো আপিলের ব্যবস্থা থাকবে না। ইচ্ছাকৃত শীর্ষ ঋণখেলাপির স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ক্রোক করে তাকে পাঠাতে হবে জেলে। জেলের ভাত না  খেলে ব্যাংকের টাকা দেবে না।

প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ তহবিল ব্যবস্থাপনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়া হবে। এ টাকা কার? কারা নিল? তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংক মার্জার করে কি হবে। সুশাসন না থাকলে এসব করে কিছুই হবে না। ব্যাংক খাতকে সংস্কার করতে হবে। আর্থিক খাত দিনের পর দিন আরও দুর্বল হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কি করছে? দক্ষতার সঙ্গে এসব  মোকাবিলা করতে না পারলে বিপর্যয় নেমে আসবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জবাবদিহিকে বলেন, শেয়ারহোল্ডারদের মতামত নিয়ে ব্যাংকগুলোর একীভূত হতে হবে। আমানতকারীদের স্বার্থের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তারা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তাদের আমানত যেন যথা সময়ে পায়। যারা নতুন একাউন্টধারী তারা যাতে নির্বিঘ্নে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তলন করতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। অন্যান্য দেশে ব্যাংকগুলো কিভাবে মার্জার বা একীভূত হয়েছে। একীভূত হতে গিয়ে তারা কোথায় সমস্যার সম্মুখিন হয়েছে এবং কোথায় সফল হয়েছে, সেগুলো বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণে জোর করে চাপিয়ে দেয়া যাবে না।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। তবে অবশ্যই সবার মতামতের ভিত্তিতে একীভূত হতে হবে। বিশেষ করে আমানতকারীরা যাতে কোনোভাবেই ক্ষতির সম্মুখিন না হন সেদিকে তিক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের ঠিকমতো সুদ দিতে পাচ্ছে না। দুই/একটি ব্যাংক একীভূত না হওয়া পর্যন্ত একীভূতকরণের ব্যাপারে মন্তব্য করা মুশকিল। বেশি পরিমাণে ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। 

এতো ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া উচিত হয়নি। নতুন ব্যাংকগুলো শক্তভাবে দাঁড়াতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কারণ তারা কম সুদে আমানত সংগ্রহ করতে পাচ্ছে না। তাদের ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো কম সুদ দেয়। তারপরেও তাদের আমানতকারীর অভাব নেই। কারণ তারা আমানতকারীদের কাছে বিশ্বাস অর্জন করেছে। আমাদের অধিকাংশ ব্যাংককেই সেই বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেই ভালো কিছু বয়ে আনবে না।

এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, যেসব ব্যাংকের নেট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি) বা প্রকৃত সম্পদ মূল্য নেগেটিভ, তারা কিভাবে একীভূত হবে? একীভূত করতে হলে তাদের এনএভি পজেটিভ করতে হবে। আর একীভূত হলেই যে ঋণখেলাপীরা পার পেয়ে বিষয়টি তেমন নয়। একীভূত হওয়ার পরেও তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব। একীভূতকরণ করতে গিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন কিছু করা ঠিক হবে না।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জবাবদিহিকে বলেন, শেষ পর্যন্ত যে সমস্ত ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, সেগুলো হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ এটি একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। অনেক বাধার মুখে পড়তে হবে। ব্যাংকের মূলধন নিয়ে সমস্যা আছে, শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার কিভাবে বন্টিত হবে? পরিচালনা পর্ষদে কারা কারা থাকবে?, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কে কোথায় যাবে? কোন নিয়মে কাজ করবে? এরকম অনেক প্রশ্ন রয়েছে এবং সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধান করে তারপরে একীভূত হতে হবে। এসব সমস্যা সমাধান সহজে করা সম্ভব না। বরং একীভূতকরণের ঘোষণায় অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত একীভূতকরণ হবে বলে আমার মনে হয় না। অনেকেই প্রভাব খাটানো শুরু করবে। তবে শেষ পর্যন্ত যদি একীভূত হয় তবে সেটি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে। কারণ ব্যাংক কমানো উচিত। কিন্তু একীভূত করতে গিয়ে যদি শক্তিশালী ব্যাংকটি দুর্বল হয়ে যায়, সেটিতো কাম্য হবে না। ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণে বাংলাদেশ ব্যাংক এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূতকরণে ব্যাংকগুলোকে চাপ প্রয়োগ করছে। এটাতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে পারে না। বেসিক ব্যাংক ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে, তারা একীভূত হবে না। পদ্মা ব্যাংকেতো কিছুই নেই। দুর্বল ব্যাংকগুলোর হিউজ লায়েবিলিটিজ নেবে কে? একীভূতকরণে সিটি ব্যাংকের আপত্তি আছে। এসমস্ত সমস্যার সমাধান না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এধরনের সিদ্ধান্ত মোটেই অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, এখনো একটি ব্যাংকও একীভূত হয়নি। আমরা পদ্মা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক একীভূতকরণের প্রস্তাব পেয়েছি। আমরা এ দুটি ব্যাংকের একীভূতকরণের অনুমোদন দিয়েছি। আরও ৪/৫টি ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়া চলমান।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ২/১ মাসে একীভূতকরণ সম্পন্ন করা সম্ভব না। এ সংক্রান্ত আমরা একটা নীতিমালা জারি করেছি। যেখানে একীভূতকরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলা আছে। নীতিমালায় বলা আছে, অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকের বিদ্যমান সমস্যা সমাধান এবং একইসঙ্গে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের কার্যক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, যাতে করে জনস্বার্থে একীভূত ব্যাংক-কোম্পানি অধিকতর সেবা প্রদান করতে পারে। কোনো দুর্বল বা সংকটাপন্ন ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলে, হস্তান্তর-গ্রহীতা ব্যাংকের মূলধন, তারল্য, খেলাপি ঋণ ইত্যাদি আর্থিক সূচক প্রভাবিত হতে পারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক অধিগ্রহণকারী ব্যাংককে নীতি সহায়তা দেবে।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


Also News   Subject:  অর্থনীতি   ব্যাংক  







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আক্তার হোসেন রিন্টু
বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ : প্রকাশক কর্তৃক ৮২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক (৩য় তলা) ওয়্যারলেস মোড়, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।
বার্তা বিভাগ : +8802-58316172. বাণিজ্যিক বিভাগ : +8801868-173008, E-mail: dailyjobabdihi@gmail.com
কপিরাইট © দৈনিক জবাবদিহি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft