বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
 

ভারতের ভিত্তিহীন বিবৃতিতে ঘটনার ভুল উপস্থাপন হয়েছে: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়    চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার নিয়ে বিকৃত তথ্য ছড়াচ্ছে ভারত: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়    অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার, বিচার নিশ্চিতের দাবি হাসনাত ও সারজিসের    চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যা প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা, আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ    একদিনের ব্যবধানে সোনার দাম আরও কমলো    ২০১ রানের বড় হার বাংলাদেশের    চলতি মাসেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু দেড়শ ছাড়িয়েছে   
উন্নতি হচ্ছে পাশাপাশি হতাশাও বাড়ছে
প্রকাশ: রোববার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫:০৩ অপরাহ্ন

যে বিদেশিরা আমাদের পছন্দ করেন, তারা অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ কেবল উন্নতি করেই ক্ষান্ত হয়নি; দারিদ্র্য ঘুচিয়ে উন্নত হওয়ার অনুকরণীয় একটি দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে। উন্নতির চেহারা ঢাকা শহরে বের হলেই হাতেনাতে চোখে-স্পর্শে টের পাওয়া যায়। বাইরে থেকে কয়েক বছর পর, এমনকি এক বছর পরেও যারা আসেন তারা এমন সব উন্নতি দেখেন যে, চিনতে পারেন না– কোথায় এলেন। তবে যাতায়াতটা ভারি কষ্টের। মেট্রো এসেছে; তাতে কারও কারও খুবই সুবিধা হয়েছে। খরচ কিছুটা বেশি, তবু সময় তো বাঁচে।

তবে মেট্রোতেও দেখা যাচ্ছে সময় সময় অচল অবস্থা। ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল ছেলেরা। সেই ঘুড়ি ছুটে এসে মেট্রোর বিদ্যুতের তারে পড়ে রীতিমতো বিপর্যয় ঘটিয়েছে। যারা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল, তারা যে ষড়যন্ত্রকারী; উন্নয়নে বিঘ্ন ঘটানোই যে তাদের উদ্দেশ্য– এমনটা বোধ হয় নয়। তবু অপরাধ তো করে ফেলেছে; শাস্তি না দিলে ওই কাজ আরও ঘটবে। শুনলাম, দু’জন অপরাধীকে তাই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

এমনিতে ঘুড়ি ওড়ানো অবশ্য কোনো অপরাধ নয়। বরং ভালো কাজই বলা চলে; নিরীহ বিনোদন। কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হয়ে খুনাখুনি করা, ছিনতাই প্রভৃতি বদমায়েশি কর্মে লিপ্ত হওয়া এবং মাদকের আসর বসানোর তুলনায় অনেক বেশি সুস্থ কাজ। আমাদের উচিত ঘুড়ি ওড়ানোকে উৎসাহ দেওয়া। কিন্তু ঘুড়ি ওড়াবে কোথায়? খোলা মাঠ কই? ঢাকা শহরে বড় বড় পার্কের অনেকই চলে গেছে লিমিটেড কোম্পানির মালিকানায়; যেখানে কিশোর তো দূরের কথা, প্রবীণদেরও প্রবেশাধিকার নেই। বাকি পার্কের অধিকাংশের বেলাতেই কিশোররা প্রবেশাধিকার পায় না। ঘুড়ি ওড়ানো তো স্বর্গীয় কল্পনা। ছাদে উঠে ওড়াবে? আগের দিনে সেটা কিছুটা সম্ভব ছিল; এখন উন্নত শহরে সেটা অত্যন্ত দুষ্কর। আর ওই যে ওড়াতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা, অপরাধী হওয়া, জেল খাটা– এসব তো ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য নতুন নিষেধাজ্ঞা। সবই কিন্তু ঘটছে উন্নতির কারণে। ঘুড়ি ওড়ানো অপরাধ, নাকি ওড়াতে না-দেওয়া এবং ওড়ানোকে বিপজ্জনক কাজ করে তোলাটা অপরাধ– এই বিচারটা কে করবে? উন্নয়ন, নাকি রাষ্ট্র? উন্নয়ন তো ঘটে রাষ্ট্রের হুকুমেই। 

আশাবাদী হওয়াটা খুবই দরকার। আশাবাদী হতে যারা আগ্রহী করছেন, তারা উন্নতির বিষয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারেন এটা লক্ষ্য করে– দেশে বড় একটা ভোক্তাশ্রেণির উত্থান ঘটেছে। তাতে বাংলাদেশে পণ্যের চাহিদা বেশ বেড়েছে। পণ্যের চাহিদা বাড়া মানেই তো উৎপাদন বাড়া। উৎপাদন বাড়া মানেই তো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু সেটা কি ঘটছে? বিদেশি পণ্যে কি বাজার ছেয়ে যায়নি? যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর উৎপাদক কোম্পানির অনেকটার মালিকানা ইতোমধ্যেই কি বিদেশিদের হাতে চলে যায়নি? অন্যরাও কি যাবার পথে উন্মুখ হয়ে নেই? সর্বোপরি উৎপাদন এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মুনাফাটা যাচ্ছে কোথায়? বড় একটা অংশই তো পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে। 

শিল্পোদ্যোক্তাদের একজনকে জানি ব্যক্তিগতভাবে, যিনি অত্যন্ত সজ্জন, পাচারে বিশ্বাসী নন। তিনি একটি বই লিখেছেন, যাতে দেশের যে উন্নতি হচ্ছে– তার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবৃদ্ধির কথা। একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকের প্রদত্ত তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের হার অতি শিগগির ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। হয়তো তাই ঘটবে। কিন্তু এই উত্থানে উৎফুল্ল হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এই উন্নতির অর্থ দাঁড়াবে একদিকে দেশের সম্পদ পাচার হওয়া, অন্যদিকে বেকার ও দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি। উচ্চবিত্তরা তাদের সম্পদ তো বটেই, এমনকি সন্তানদেরও দেশে রাখবে না। ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার জন্য বিদেশগামীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। একটি পত্রিকা জানাচ্ছে, গত ১০ বছরে ওই স্রোত দ্বিগুণ পরিমাণে স্ফীত ও বেগবান। পাশাপাশি এটাও আমাদের জানা আছে যে, বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আসা ক্রমাগত কমছে। 

নির্মম সত্য– যতই উন্নতি ঘটছে, ততই কমছে দেশপ্রেম। তাই বলে দেশপ্রেম কি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে? না, মোটেই নয়। দেশপ্রেম অবশ্যই আছে। বিশেষভাবে আছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে। তারা অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করবে– এমনটা ভাবতেই পারে না। বেশির ভাগই দেশে থাকে, পরিশ্রম করে এবং তাদের শ্রমের কারণেই দেশের যেটুকু উন্নতি, তা সম্ভব হয়েছে। ভোক্তারা নয়, মেহনতিরাই হচ্ছে উন্নতির চাবিকাঠি। ঋণ করে, জায়গাজমি বেচে দিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের কেউ কেউ বিদেশে যায়; থাকবার জন্য নয়, উপার্জন করে টাকা দেশে পাঠাবে বলে। বিদেশে গিয়ে অনেকেই অমানবিক জীবন যাপন করে; ‘অবৈধ’ পথে গিয়ে এবং প্রতারকদের কবলে পড়ে কেউ কেউ জেল পর্যন্ত খাটে। কিন্তু তারা বুক বাঁধে এই আশায়– দেশে তাদের আপনজন খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে। বিত্তবানরা যা ছড়ায়, তা হলো হতাশা। এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই– এটাই তাদের স্থির বিশ্বাস। হতাশা কিন্তু তারাই সৃষ্টি করে, বিশেষভাবে সম্পদ পাচার করার মধ্য দিয়ে। এই যে দেশে এখন ডলার সংকট চলছে এবং যার ফলে সবকিছুর দাম বেড়েছে, তার প্রধান কারণ টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা বিত্তবানদের কাজ। 

হতাশা হচ্ছে একটি রোগ। শুধু রোগ নয়, সংক্রামক রোগ বটে। একাত্তরে যখন আমরা চরমতম বিপদের মধ্যে ছিলাম, মৃত্যুর শঙ্কায় দিনরাত সন্ত্রস্ত থাকতাম, তখন অমন চরমতম বিপদ ও সীমাহীন অত্যাচারের মুখেও আমরা কিন্তু হতাশ হইনি। কারণ আমরা জানতাম, কেউ একা নই; সবাই আছি একসঙ্গে এবং লড়ছি একত্র হয়ে। ১৬ ডিসেম্বরেই কিন্তু সেই ঐক্যটা ভাঙবার লক্ষণ দেখা দিয়েছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে একেবারে খান খান হয়ে গেছে। সমষ্টি হারিয়ে গেছে, সত্য হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে উন্নতি করা, না-পারলে কোনোমতে বেঁচে থাকা। 

এমনটা কেন ঘটল? ঘটল এই কারণে যে, উত্থান ঘটল লুণ্ঠনের, জবরদখলের, ব্যক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধির। এবং এসবই প্রধান সত্য হয়ে দাঁড়াল। একাত্তরে আমরা সমাজতন্ত্রী হয়েছিলাম। বাহাত্তরে দেখা গেল, সমাজতন্ত্র বিদায় নিচ্ছে, পুঁজিবাদ এসে গেছে এবং পুঁজিবাদেরই অব্যাহত বিকাশ ঘটেছে বাংলাদেশে। দেখা গেছে, পরের সরকার আগেরটির তুলনায় অধিক মাত্রায় পুঁজিবাদী এবং একই সরকার যদি টিকে থাকে তবে আগেরবারের তুলনায় পরেরবার পুঁজিবাদের জন্য অধিকতর ছাড় দিচ্ছে। 

পুঁজিবাদের বিকাশের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করবার জন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি; পুঁজিবাদের বিকাশ তো পাকিস্তান আমলে বেশ গোছগাছ করেই এগোচ্ছিল। আমরা চেয়েছিলাম সকলের মুক্তি; চেয়েছিলাম প্রত্যেকেই যাতে মুক্তি পায়।

(সংগৃহীত)

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আক্তার হোসেন রিন্টু
বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ : প্রকাশক কর্তৃক ৮২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক (৩য় তলা) ওয়্যারলেস মোড়, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।
বার্তা বিভাগ : +8802-58316172. বাণিজ্যিক বিভাগ : +8801868-173008, E-mail: dailyjobabdihi@gmail.com
কপিরাইট © দৈনিক জবাবদিহি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft