বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) মধ্যরাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রবেশের ঘটনায় দ্বিতীয় দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
আজ শনিবার সকাল থেকে ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নামেন তারা। এদিন আগের দিনের পেশ করা দাবি-দাওয়া সংশোধন করে ৬ দাবি পেশ করেন শিক্ষার্থীরা। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি স্থগিত করেন তারা।
দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা সকাল ১১টায় বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে নতুন দাবি (সংশোধিত) জানিয়েছি। আমরা এই মুহূর্তে ওই দাবিতেই অটল থাকবো, আমাদের আর কোনও নতুন দাবি নেই। এই দাবিগুলোর সঙ্গে আমরা উপস্থিত সবার গণস্বাক্ষর নিয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। আমরা দেখি আমাদের স্যার আমাদের সঙ্গে পরবর্তীতে কথা বলতে চান কিনা, কোনও আপডেট দিতে চান কিনা। আমরা এখনও জানি না। আমরা আবেদনপত্র জমা দিয়ে এসেছি এবং এখনও পর্যন্ত আমাদের দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা দাবির বাস্তবায়ন চাই এবং দাবির বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চলমান রাখবো।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, আমাদের আগামীকালের কর্মসূচি হচ্ছে সকাল ৭টায় শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হয়ে যাবো। আমাদের আজ দুপুর ২টা পর্যন্ত আলটিমেটাম ছিল। তবে ইতিমধ্যে আমাদের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং প্রচণ্ড রকমের গরম। আমরা আমাদের ভিসি স্যার ও ডিএসডব্লিউ স্যারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও আশ্বাস বা কিছু পাইনি। তাই ২টা পর্যন্ত অবস্থান করাটা আমাদের জন্য ফলপ্রসূ হবে না।
পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আজ সকাল ৮টায় বুয়েটের বিভিন্ন প্রবেশপথে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এরপর সকাল ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে আগের ছয় দফা দাবি সংশোধন করে উপস্থাপন করেন গণমাধ্যমের সামনে। এসময় তারা সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর স্থায়ী বহিষ্কার দাবি করেন।
‘সংশোধিত দাবি’র বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে তারা বলেন, আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা গত ২৮ মার্চ মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে বহিরাগত অনুপ্রবেশে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি। এই মর্মে বুয়েট ক্যাম্পাসকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে বুয়েট প্রশাসনের নিকট নিম্নোক্ত দাবিগুলো গতকাল (শুক্রবার) পেশ করেছিলাম। সেগুলোরই বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সবাইকে সম্যক অবহিত করছি এবং ঘটনাপ্রবাহ অনুযায়ী আমাদের পরিবর্তিত দাবি আবারও পেশ করছি।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো-
১. মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক ইমতিয়াজ রাব্বি ‘বুয়েটে সব রকম রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ’ এই নীতিমালা ভঙ্গ করার কারণে আমরা আজ সকাল ৯টার মধ্যে ইমতিয়াজ রাব্বির বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার এবং হলের সিট বাতিলের দাবি জানিয়েছিলাম। প্রশাসন কর্তৃক ইমতিয়াজ রাব্বির হল থেকে বহিষ্কার ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হলেও বুয়েট থেকে তার স্থায়ী অ্যাকাডেমিক বহিষ্কার এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত করা হয়নি। আমরা আজ দুপুর ২টার মধ্যে লিখিতভাবে ইমতিয়াজ রাব্বির স্থায়ী অ্যাকাডেমিক বহিষ্কার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।
২. উক্ত ঘটনায় ইমতিয়াজ রাব্বির সঙ্গে বুয়েটের বাকি যেসব শিক্ষার্থীরা জড়িত ছিল তাদের একাংশের নাম পরিচয় আমরা ছবি এবং ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত করেছি। তারা হলো এ এস এম আনাস ফেরদৌস (আইডি: ১৮১৮০০৪), মোহাম্মদ হাসিন আরমান নিহাল (আইডি: ২১০৬১০১), অনিরুদ্ধ মজুমদার (আইডি: ২১০৬০৭৯), জাহিরুল ইসলাম ইমন (আইডি: ২১১২০৩১) এবং সায়েম মাহমুদ সাজেদিন রিফাত (আইডি: ২১০৬১২৬)। আমরা ইমতিয়াজ রাব্বির মতোই বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধানের নিয়ম ভঙ্গের দায়ে এবং বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক অপশক্তি অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা করায় এদের সবার বুয়েট থেকে স্থায়ী অ্যাকাডেমিক এবং হল বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছি। এদের বাইরে বাকি আরও যারা জড়িত ছিল যাদেরকে আমরা শনাক্ত করতে পারিনি, তাদের সবাইকেই যেন বুয়েট প্রশাসন অনতিবিলম্বে শনাক্ত করে এবং উপরে উল্লিখিত অভিযুক্তদের মতোই একই মেয়াদে শাস্তির ব্যবস্থা করে।
৩. বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলো, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, তারা কেন, কীভাবে প্রবেশ করার অনুমতি পেলো এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট সদুত্তর এবং জবাবদিহিতা গতকালই আমরা প্রশাসনের কাছে চেয়েছিলাম। তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মাননীয় উপাচার্য আমাদের মৌখিক ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমরা এই মুহূর্তে এই দাবিটির বিষয়ে বুয়েট প্রশাসনের কাছ থেকে লিখিত নোটিশ এবং বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি।
8. শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য ‘রাত সাড়ে ১০টার পরে সব ছাত্রছাত্রীর ক্যাম্পাসে থাকা নিষেধ’ এবং যেকোনও প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের রাত সাড়ে ১০টার পরও ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে হলে সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদফতরের পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) স্যারের অনুমতির প্রয়োজন পড়ে।
(ক) এক্ষেত্রে যদি বহিরাগতদের অনুমতি দেওয়া না হয়ে থাকে, তাহলে ডিএসডব্লিউ স্যারের প্রটোকল ভেঙে বহিরাগতরা মধ্যরাতে সেমিনার রুমে মিটিং করতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে ডিএসডব্লিউ স্যার নিজের প্রটোকল অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ।
(খ) আর যদি বহিরাগতদের পারমিশন দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে বুয়েটের ‘রেজিস্ট্রার অফিসের প্রটোকল: ১১ অক্টোবর, ২০১৯’ এ দেওয়া ঘোষণা ‘বুয়েটে সব প্রকার রাজনৈতিক সংগঠন এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ’ ইহার লঙ্ঘন করেছেন ডিএসডব্লিউ স্যার।
(গ) ক্যাম্পাসের অডিটোরিয়াম, সেমিনার রুম, ক্যাফেটেরিয়া সংলগ্ন জায়গার ব্যবহার ডিএসডাব্লিউ আওতাধীন। উনি বলেছেন, এ জায়গাগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে উনি অনুমতি দেননি। এক্ষেত্রে উনার অনুমতি ব্যতিরেকে বহিরাগতদের এ জায়গাগুলো ব্যবহার করার মতো ধৃষ্টতামূলক আচরণ ডিএসডাব্লিউ এর দায়িত্বপালনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ এমন ডিএসডাব্লিও এর দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদত্যাগ চাই।
৫. ক্যাম্পাসে মধ্যরাতে বহিরাগতদের প্রবেশের কারণে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এর প্রতিবাদ হিসেবে আজ ৩০ মার্চের টার্ম ফাইনাল আমরা বর্জন করছি এবং আগামীকাল ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনালসহ সব অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করছি।
৬. আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনোরকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
দাবি পেশ শেষে চলমান আন্দোলন নিয়ে তারা বলেন, বক্তব্য শেষ করার আগে আমরা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। গতকাল আমাদের আন্দোলনের পর তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠনের কিছু ব্যক্তিবর্গকে ফেসবুকে পোস্ট করে আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে অপপ্রচার চালাতে দেখি। আমরা তাদের এমন বক্তব্যের ধিক্কার জানাই। আমরা সবসময়ই বুয়েটের সংবিধানে থাকা ‘বুয়েটে সব রকম ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’ এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সংঘবদ্ধ এবং যেকোনও মূল্যে বুয়েটকে ছাত্ররাজনীতির হাত থেকে মুক্ত রাখতে বদ্ধ পরিকর।
‘আমরা আবারও সুস্পষ্ট করে বলতে চাই, আমাদের এসব দাবি কেবল কোনও বিশেষ ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়, বরং আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুয়েটের সংবিধান অনুযায়ী সকল রকম ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছি।’