দেশের কৃষিজমি, বনভূমি, পাহাড়, টিলাসহ ভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার রোধ এবং এর সুরক্ষায় খসড়া আইনটি দ্রুত পাশ করতে সংসদকে পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া এক রায়ে এ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নওগাঁর মিজানুর রহমানকে পুকুর খনন বন্ধ করতে স্থানীয় ভূমি অফিসের নোটিশ অবৈধ ঘোষণা করে ২০২২ সালের ২ জুন এ রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ১৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। রায়টি লিখেছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।
আদালত বলেছেন, ‘বাংলাদেশের কৃষি জমি, বনভূমি, টিলা, পাহাড় ইত্যাদি সুরক্ষার জন্য আইনটি দ্রুত জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস হওয়া অতি আবশ্যক। আমরা আমাদের দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা করতে পারলে পরিবেশ এবং প্রতিবেশ সম্পর্কিত বিপর্যয় মোকাবেলা করতে আমরা সক্ষম হব। সারা দেশে ভূমির ওপর চাপ বাড়ছে। একদিকে মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে কমে আসছে কৃষিজমির পরিমাণ।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ভূমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর। জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরলে মাথাপিছু ভূমির পরিমাণ ০.০৯ হেক্টর। সিঙ্গাপুর ছাড়া মাথাপিছু এত কম জমি আর কোনো দেশে নেই। এই সামান্য পরিমাণ জমিতেই বসবাস, উৎপাদন, জীবন-যাপন।
এদিকে সরকারের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, দেশের ১ কোটি ১২ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর ভূমি অবক্ষয়ের শিকার। এটি দেশের মোট ভূমির ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ। তাই ভূমি রক্ষার তাগিদ থেকে ২০০৯ সালে কৃষিজমি রক্ষায় আইন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন-২০১০’ শিরোনামে আইনটির খসড়া প্রকাশ করা হয়।
২০১৫ সালে শিরোনাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ২০১৬’। পরে তা ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন-২০২১’ করা হয়। সর্বশেষ গত বছর ‘ভূমি জোনিং ও সুরক্ষা আইন, ২০২৪’ নামে নতুন একটি আইনের খসড়া প্রস্তাব প্রণয়ন করে ভূমি মন্ত্রণালয়। মতামত জানতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক পোর্টালে আইনটির খসড়া আপলোড করা হয়।
আইনটির গুরুত্ব তুলে ধরে এক বিজ্ঞপ্তিতে ভূমি মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, আবাসন বাড়িঘর তৈরি, উন্নয়নমূলক কাজ, শিল্পকারখানা স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং প্রাকৃতিক কারণে প্রতিনিয়ত ভূমির প্রকৃতি ও শ্রেণিগত ব্যবহারের পরিবর্তন হচ্ছে। আবার দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজমি, বনভূমি, টিলা, পাহাড় ও জলাশয় বিনষ্ট হয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনের নিমিত্তে কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ধরনের জরুরি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উল্লেখিত আইনটি জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ, আবাসন, বাড়িঘর তৈরি, উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, শিল্পকারখানা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ রোধ করা; ভূমির শ্রেণি বা প্রকৃতি ধরে রেখে পরিবেশ রক্ষা ও খাদ্যশস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা। এর পাশাপাশি কৃষিজমি, বনভূমি, টিলা, পাহাড়, নদী, খালবিল ও জলাশয় সুরক্ষাসহ ভূমির পরিকল্পিত ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। এবং ভূমির ব্যবহার নিশ্চিত করে পরিকল্পিত জোনিংয়ের মাধ্যমে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন নিশ্চিত করা।’
বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি কৃষিজমি সুরক্ষার বিষয়টি আইনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ আইনে জমির উর্বরতা শক্তির অননুমোদিত ব্যবহার থেকে রক্ষা করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যাতে টেকসই খাদ্য–ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। উপরন্তু জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে জলাভূমি, বন ও নদী–ব্যবস্থার মতো পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলগুলো সংরক্ষণের জন্য বিশেষ বিধানগুলোর রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।’
আইনের খসড়ায় ভূমি জোনিংয়ের জন্য ১০টি শ্রেণিবিন্যাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে আবাদি, আবাসিক, বাণিজ্যিক, জলাভূমি, নদী, বন, পাহাড়, রাস্তা, শিল্প ও ধর্মীয় স্থান। এ আইনের অধীনে অনধিক দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, ফসলি জমিতে পুকুর খননের বিধিনিষেধ আরোপ করে ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ব্যবহার আইন, ২০১৬’ এর খসড়া প্রণয়ন করা হলেও কোনো এক অজানা কারণে এটি এখনো আলোর মুখ দেখছে না।
উচ্চ আদালত রায়ে বলেছেন, নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর এবং যেকোনোভাবে এর বিলি- ব্যবস্থা তথা শ্রেণি পরিবর্তন এর অধিকারে পরিবর্তন, বিধি-নিষেধ এবং যেকোনো প্রকারের নিয়ন্ত্রণ কেবলমাত্র সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের মাধ্যমে করতে হবে। আইনটির হালনাগাদ অবস্থা জানতে ভূমি সচিব মো. খলিলুর রহমানকে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।