এ পর্যন্ত ৩৮টি মামলা হয়েছে আলোচিত অর্থপাচারকারী প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে। তবে আইনি জটিলতার কারণে তাকে দেশে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ আরেকটি মামলা দায়ের করা হয় ৪১ কোটি টাকা আত্মাসাৎ ও পাচারের অভিযোগে। কয়েকটি মামলায় চার্জশিট দিয়েছে দুদক। আদালতে বিচারাধীন দুটি মামলার একটিতে গত বছরের ৮ অক্টোবর পিকে হালদারসহ ১৪ জনকে ২২ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০। একই সঙ্গে জরিমানা করা হয় এক হাজার ৫২২ কোটি ৫৫ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ টাকা। যদিও পিকে হালদারের অনুপস্থিতিতেই এসব মামলা, চার্জশিট ও সাজা দেওয়া হয়েছে। আইনি জটিলতার কারণে তাকে ফেরত আনার বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
দুদকের উপ-পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম জানান, গত ৪ এপ্রিল দায়ের করা মামলার বাদী হয়েছেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নাজমুল হুসাইন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন— অবৈধভাবে ভুয়া কাগুজে প্রতিষ্ঠান কনিকা এন্টারপ্রাইজের নামে ভুয়া রেকর্ডপত্র তৈরি করে সঠিক হিসেবে উপস্থাপন ও ব্যবহার করেন পিকে হালদার। পরে এই কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৪৫ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করে ৪১ কোটি ৩১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৫৭ টাকা আত্মসাৎ করে দেশের বাইরে পাচার করেছেন তিনি। এ মামলায় পিকে হালদারসহ আসামি করা হয়েছে ২০ জনকে। এদের সবাই এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিইও, পরিচালক ও বিভিন্ন পদবীর কর্মকর্তা। ঘটনার সময়কাল দেখানো হয়েছে— ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
২০১৯ সালের অক্টোবরে দুদকের তদন্তে অর্থ কেলেঙ্কারির বিষয়টি উঠে আসার গোপন সংবাদ পেয়েই পিকে হালদার পালিয়ে যান ভারতে। সেখানে শিবশঙ্কর হালদার নামে জালিয়াতি করে নাগরিকত্ব নেন। কিন্তু ২০২২ সালের ১৪ মে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ভারতের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্ট (ইডি)। এরপর থেকেই ভারতের কারাগারে আছেন বাংলাদেশের আর্থিক কেলেঙ্কারির এ খলনায়ক। ভারতে গ্রেফতারের পর দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈউদ্দীন আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব আন্তর্জাতিক আইন ও বন্দিবিনিময় চুক্তির আলোকে পিকে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।
দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বাধীন একটি টিম পিকে হালদারের বিরুদ্ধে মামলাগুলো দায়ের করেন। এরমধ্যে দুটি মামলার বিচার চলছে আদালতে। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত চলছে এখনও। পিকে হালদার যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ লোপাট করেছেন সেগুলো হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এই চারটি প্রতিষ্ঠান দখলে রেখে পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন এবং সেই অর্থ দেশের বাইরে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যদিও এ পর্যন্ত দুদকের ৩৮টি মামলায় পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রাভেল, হাল প্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি, আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, সুখাদা লিমিটেড, রেপটাইল ফার্ম, সন্দ্বীপ ইন্টারন্যাশনাল, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল, বর্ণা, ইমেক্সো, আরবি এন্টারপ্রাইজ, কনিকা এন্টারপ্রাইজ ও এসএ এন্টারপ্রাইজসহ নানান কাগুজে প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণ মঞ্জুর করা হয় এবং এসব অর্থের বড় একটি অংশ দেশের বাইরে কানাডা ও ভারতে পাচার করে দেন পিকে হালদার। ২০১৪ সালে ছোট ভাই প্রীতেশ কুমার হালদারের সঙ্গে পিএন্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কানাডায় একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন তিনি। ২০১৮ সালে দুই ভাই মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান খুলে সেখানেও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেন।
পিকে হালদারকে ফেরানো ও তার পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে দুদকের কমিশনার জহুরুল হক এর আগে বলেছেন, পিকে হালদারকে ফেরত আনার বিষয়টি তাদের একক এখতিয়ারে নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন পর পর তাগাদাও দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আরও যাদের এখতিয়ার আছে, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে দুদক।
উল্লেখ্য, পলাতক প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পিকে হালদার) দেশে ফিরিয়ে আনতে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন) থেকে রেড নোটিশ জারি করা আছে। বাংলাদেশ পুলিশের অনুরোধের পর ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি পিকে হালদারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ভারতের আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকায় তাকে ফেরত আনা যাচ্ছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা