মাতৃগর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব আসার পর থেকে সন্তানকে পৃথিবীতে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিয়ে তাকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষার অন্ত থাকে না একটি পরিবারের। অথচ অনেক সন্তানকে দুনিয়াতে আসার পরই নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়। মায়ের কোলে যার ঠাঁই হওয়ার কথা, সেই নবজাতকের ঠিকানা হয় ডাস্টবিন, রাস্তা, জঙ্গল, পুকুর বা নদী। কিংবা রাস্তার পাশে।
নবজাতকের জন্মের পর তাকে ডাস্টবিনে, রাস্তা, পুকুর, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, শৌচাগার, ড্রেন, খাল ও নালা-নর্দমায় ফেলা দেয়ার ঘটনা ঘটছে। সদ্যোজাত ফুটফুটে শিশুর হাসি দেখে নিষ্ঠুর মানুষের হৃদয়ও গলে যায়। অথচ অনেক মা-বাবা তাদের অনৈতিকতা ও অপরাধ ঢাকার জন্য মূলতঃ গর্ভপাত করে নিষ্পাপ ও নিরপরাধ নবজাতককে ফেলে দিচ্ছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝে-মধ্যেই ডাস্টবিন, রাস্তা, জঙ্গল, পুকুর বা নদী থেকে নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। তাদের কেউ জীবিত থাকলে তাকে প্রশাসন নিজেদের জিম্মায় নেয়। তবে বেশির ভাগ নবজাতকের স্থান হয় হাসপাতালের মর্গে। এসব ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও গ্রেপ্তার হয়না ঘটনার সাথে জড়িত কেউ। মাঝে মধ্যে দেখা যায় ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া নবজাতক শিয়াল-কুকুরের খাবারে পরিণত হচ্ছে। হতভাগ্য শিশু মৃত্যুর সময় পায় না মায়ের বুকের এক ফোটা দুধ বা পানি।
জানা যায়, গত বছরের ২৭ আগস্ট বগুড়ায় শপিংব্যাগ থেকে একটি, ২৫ আগস্ট পাবনায় ডাস্টবিন থেকে একটি, ২৩ আগস্ট বিকালে ফতুল্লার মাসদাইর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে একটি, ১৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে ডাস্টবিনের ভেতর থেকে একটি, এর আগে ৩১ জুলাই গাজীপুরের শিল্পনগরী টঙ্গীতে একটি, ২৪ জুলাই ঢাকার রমনা উদ্যানের ভেতরে দুইটি নবজাতককে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর কতজন নবজাতককে পাওয়া যায়, তার পরিসংখ্যান কোনো সংস্থা বা মানবাধিকার সংগঠনের কাছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাধারণত বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামী পরিত্যক্ত কিংবা ধর্ষণ থেকে জন্মানো শিশুগুলোর ক্ষেত্রেই এমন পরিণতি বেশি হচ্ছে। এছাড়াও ছেলে শিশু প্রত্যাশা করার পর মেয়ে শিশু জন্মানোর কারণেও অনেক পরিবার শিশুদের রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা জন্ম নিরোধ বিষয়ে সচেতনতার অভাবও এক্ষেত্রে একটা বড় কারণ।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডক্টর রিজিয়া সুলতানা বলেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বিয়ে বহির্ভূত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। ফলে এসব নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি বেড়ে যাচ্ছে জীবন্ত নবজাতককে ফেলে দিয়ে সব দায় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ঘটনা। এতে করে নবজাতকের জন্মদাতা বাবা-মা হয়তো নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কিন্তু ফেলে দেওয়া নবজাতকের কপালে কী ঘটছে- তা কি কেউ এবার ভেবেছেন। ডাস্টবিন, ফুটপাত, ঝোপ ও শৌচাগার এসবই যেন অনাকাঙ্খিত নবজাতকদের ঠিকানা হয়ে উঠছে।
এসব ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত একজনও আটক হয়নি। যৌনশিক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দিতে হবে। এসব ঘটনা থেকে পরিত্রাণে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। আমরা যতই আধুনিক হই না কেন, পরিবারকে সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে। মা-বাবা পেশার কারণে যত ব্যস্ত থাকুন না কেন, জীবন সম্পর্কে সন্তানকে শিক্ষা তাদের দিতে হবে বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট আব্দুল মোবিন বলেন, দেশের আইনানুযায়ী কোনো শিশু মাতৃগর্ভে ৪ মাস পার করলে শিশুটি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য হয় এবং জন্ম হওয়ার আগে তার নামে সম্পত্তিও লিখে দেয়া যায়। তাই নবজাতক শিশুদের হত্যা করার বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে জানান তিনি।