অর্থ আত্মসাতের মামলায়ও জামিন পেলেন ড. ইউনূস

শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় জামিনের মেয়াদ বাড়ার পর গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের টাকা আত্মসাতের মামলাতেও আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস।
আজ রোববার তিনি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে শুনানি শেষে বিচারক তা মঞ্জুর করেন।
ইউনূসের পাশাপাশি এ মামলার সাত আসামির জামিন মঞ্জুর করেন বিচারক।
তারা হলেন– গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালক পারভীন মাহমুদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম এবং পরিচালক এস. এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী।
মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্যদের পক্ষে জামিন শুনানি করে অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আল মামুন। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল।
জামিন শুনানিতে ইউনূসের আইনজীবী বলেন, “শ্রমিকদের সঙ্গে গ্রামীণ টেলিকমের সেটেলমেন্ট হয়েছে। এর অংশ হিসাবে ৪৩৭ কোট টাকা তারা শ্রমিকদের দিয়েছেন। হাই কোর্টের কোম্পানি বেঞ্চের আদেশ অনুযায়ী চুক্তিপত্র করে ওই টাকা দেওয়া হয়েছে।”
এ বক্তব্যের বিরাধিতা করে কাজল বলেন, “৪৩৭ কোট টাকার ডিসপিউট বা অভিযোগ এটি নয়। মামলার অভিযোগ ২৬ কোটি টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে প্রতারণা ও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। আসামিরা শ্রমিকদের পাওনা ২৬ কোটি টাকা শ্রমিকদের না দিয়ে ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের দিয়েছেন। এতে করে সাধারণ শ্রমিকরা বঞ্চিত হয়েছেন।”
দুই পক্ষের শুনানি নিয়ে বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন ইউনূসসহ আট আসামির জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
এর আগে সকালে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় স্থায়ী জামিনের আবেদন করেন ইউনূস। শুনানি শেষে বিচারক এম এ আউয়াল জামিন মঞ্জুর করে আগামী ১৬ এপ্রিল শুনানির পরবর্তী তারিখ রাখেন।
শ্রম আইন লঙ্ঘন করে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগে কোম্পানির চেয়ারম্যান, শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসসহ চার কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে গত ১ জানুয়ারি ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় তৃতীয় শ্রম আদালত।
ইউনূসের পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান এবং দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহানকে শ্রম আইনের ৩০৩ এর ৩ ধারায় ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে, অনাদায়ে আরও ১০ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরে ওই আদালতই তাদের জামিন দেয়। এরপর গত ২৮ জানুয়ারি তারা শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করেন। ওইদিন আপিল গ্রহণ করে পরবর্তী ধার্য তারিখ (৩ মার্চ) পর্যন্ত জামিন বহাল রাখে আপিল ট্রাইব্যুনাল।
সেই জামিনের মেয়াদ শেষে রোববার স্থায়ী জামিনের আবেদন করা হয় ইউনূসের পক্ষে। শুনানির শুরুতে আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন আবেদন পড়ে শোনান।
এরপর কলকারখানা অধিদপ্তরের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম জামিন স্থায়ী না করে পরবর্তী ধার্য তারিখ পর্যন্ত জামিন দেওয়ার কথা বলেন।
এ সময় বিচারক এম এ আউয়াল বলেন, আপিলের রীতি অনুযায়ী প্রথম আপিলের সময় পরবর্তী ধার্য তারিখ পর্যন্ত জামিন দেওয়া হয়। এর পরের তারিখে স্থায়ী জামিন দেওয়া হয়।
“গত ২৮ জানুয়ারি আপিলের দিন আমরা জামিন দিয়েছিলাম; তবে আদালতে সময় উল্লেখ করিনি। কিন্তু গণমাধ্যমে কেউ কেউ স্থায়ী জামিন বলে উল্লেখ করেছেন। এটা হয়তো মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হতে পারে। আজ জামিন বর্ধিত করছি। তবে সময় পরে জানানো হবে।”
২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলাটি দায়ের করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান।
শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।
গত ১ জানুয়ারি ওই মামলার রায়ে চার জনকেকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা। তবে আপিলের শর্তে সেদিনই সাজাপ্রাপ্তদের এক মাসের জামিন দেওয়ায় কাউকে কারাগারে যেতে হয়নি।
দণ্ডিত বাকি তিনজন হলেন গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান এবং দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান।
শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অন্য মামলাটি দায়ের করেছে দুদক।
২০২৩ সালের শুরুতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি অডিট প্রতিবেদন পাঠিয়ে দুদককে অনুসন্ধানের অনুরোধ করা হয়। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় দুদকের উপ পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ওই বছরের ৩০ মে ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এরপর সাত মাসের বেশি সময় তদন্ত চালিয়ে আরো একজনের নাম যুক্ত করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র তৈরি করেন তিনি। গত ২৯ জানুয়ারি ওই অভিযোগপত্র অনুমোদন করে দুদক।
এরপর ১ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র আদালতে জমা পড়লে বিচারক ৩ মার্চ আসামিদের উপস্থিতিতে অভিযোগপত্রগ্রহণ এবং মামলা আমলে নেওয়ার শুনানির তারিখ রাখে।
ইউনূস ছাড়া এ মামলার অপর আসামিরা হলেন– গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম, এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম এবং গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ইউনূস ও নাজমুল ইসলামসহ গ্রামীণ টেলিকম বোর্ড সদস্যদের উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ৯ মে ১০৮তম বোর্ডে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় একটি হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত হয়। তবে ব্যাংকে হিসাব খোলা হয় এক দিন আগেই।
গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের পাওনা লভ্যাংশ বিতরণের জন্য গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন এবং গ্রামীণ টেলিকমের সঙ্গে সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট চুক্তি হয় ওই বছরের ২৭ এপ্রিল।
এজাহারে বলা হয়, সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টেও ৮ মে খেলা ব্যাংক হিসাব দেখানো আছে, যা বাস্তবে অসম্ভব। ‘ভুয়া’ সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টের শর্ত অনুযায়ী ও ১০৮তম বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গ্রামীণ টেলিকমের ৪৩৭ কোটি ১ লাখ ১২ হাজার ৬২১ টাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর শাখা থেকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় স্থানান্তর করা হয় ২০২২ সালের ১০ মে।
পরে ২২ জুন অনুষ্ঠিত ১০৯তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অ্যাডভোকেট ফি হিসাবে অতিরিক্ত ১ কোটি ৬৩ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৯ টাকা প্রদানের বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়।
অন্যদিকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখার হিসাব থেকে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নামে ডাচ বাংলা ব্যাংকের লোকাল অফিসের হিসাব থেকে তিন দফায় মোট ২৬ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা স্থানান্তর করা হয়।
দুদক বলছে, কর্মচারীদের লভ্যাংশ বিতরণের আগেই তাদের না জানিয়ে ‘অসৎ উদ্দেশ্যে’ ২০২২ সালের মে ও জুন মাসের বিভিন্ন সময়ে সিবিএ নেতা মো. কামরুজ্জামান, মাইনুল ইসলাম ও ফিরোজ মাহমুদ হাসানের ডাচ বাংলা ব্যাংকের মিরপুর শাখার হিসাবে ৩ কোটি টাকা করে স্থানান্তর করা হয়।
একইভাবে আইনজীবী মো. ইউসুফ আলীর কমার্শিয়াল ব্যাংক অফ সিলনের ধানমন্ডি শাখার হিসাবে ৪ কোটি টাকা ও দি সিটি ব্যাংকের গুলশান শাখার হিসাবে ৫ কোটি টাকা এবং আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ ও আইনজীবী মো. ইউসুফ আলীর স্ট্যান্ডার্ড টাচার্ড ব্যাংকের গুলশান নর্থ শাখায় যৌথ হিসাবে ৬ কোটি স্থানান্তর করা হয়, যা তাদের ‘প্রাপ্য ছিল না’ বলে দুদকের ভাষ্য।
দুদকের রেকর্ডপত্র অনুযায়ী, অ্যাডভোকেট ফি হিসেবে প্রকৃতপক্ষে হস্তান্তরিত হয়েছে মাত্র ১ কোটি টাকা। বাকি ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বোর্ড সদস্যদের সহায়তায় গ্রামীণ টেলিকমের সিবিএ নেতা এবং আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টের শর্ত লঙ্ঘন করে ‘অসৎ উদ্দেশে জালিয়াতির আশ্রয়ে গ্রামীণ টেলিকম থেকে উক্ত অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।’
এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২)(৩) ধারায় অভিযোগ এনেছে দুদক।