
২৪ শে ফেব্রুয়ারি ছিল ঐতিহাসিক মেহেরপুর জেলা দিবস। ১৯৮৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতার সুতিকাগার ও দেশের প্রথম সরকারের শপথস্থল এবং নীলকরদের স্মৃতি বিজড়িত মেহেরপুরকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
অথচ-কোন উৎসব, স্বরণসভা, স্মৃতিচারণ বা কোন কর্মসূচী ছাড়াই নীরবে দিনটি পার করলো জেলাবাসী। মুন্সি শেখ জমির উদ্দিন এর স্মৃতি বিজড়িত, স্বামী নিগমানন্দ ও বলরাম হাড়ির জন্মচরণসমৃদ্ধ করেছে এই জেলাকে। ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর রয়েছে এই জেলার রাজ টিকা হয়ে। মূলত: কৃষিনির্ভর এই জেলায় এখনো শিল্পায়নের ছোঁয়া লাগেনি।
শিক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকলেও কৃষি এই জেলার অর্থনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ। অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে এই জেলার কৃষকদের ভূমিকার পাশাপাশি প্রবাসীদের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক রেমিটেন্স এই জেলার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
এই জেলার মাটি উর্বর। তাই বছর জুড়ে অনাবাদি থাকেনা এক ইঞ্চিও জমি। কৃষকদের প্রচেষ্টায় মেহেরপুর কৃষিতে অনেক দূর এগিয়েছে। এই জেলার ফুলকপি, বাধাকপি সহ হরেক সবজি বিদেশে যায়। কৃষির পাশাপাশি এখানকার আমের সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে। মেহেরপুরের হিমসাগর, বোম্বায়, ল্যাংড়া আম এখন ইউরোপে যায়। এ জেলার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল গ্রীণিজ বুক খ্যাত।
এখন পিছিয়ে পড়া এই জেলার শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যদি শিল্পায়নের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে মেহেরপুর হতে পারে দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ একটি জেলা।
১৯৮৪ সালেতৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের এক ঘোষণায় ১৯ জেলা থেকে ৬৪ জেলার বাংলাদেশ গঠিত হয়। এইদিন বৃহত্তর কুষ্টিয়া থেকে বিভক্ত হয়ে মেহেরপুর কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা ৩টি জেলায় পরিণত হয়।
মেহেরপুরকে জেলা ঘোষণার পিছনে তৎকালীন সময়ের প্রভাবশালী সাংবাদিক কলামিষ্ট (এরশাদের শিক্ষক খ্যাত) আলহাজ্ব শামসুল হুদা সহ তৎকালীন সময়ের সব দলের রাজনৈতিক নেতাদের ভ‚মিকা অন্যতম।
প্রথমে মেহেরপুর ও গাংনী এই দুই উপজেলা নিয়ে মেহেরপুর জেলা গঠিত হলেও পরে ২০০০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুজিবনগরকে উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তিনটি উপজেলা নিয়ে মেহেরপুর জেলা হয়।
এ জেলায় মোট ২০ ইউনিয়ন সহ ২৬৪ টি গ্রাম রয়েছে। ভারত সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের অন্যতম শান্তির জেলা হিসেবে স্বীকৃত ও নন্দিত এই জেলা।
ইতিমধ্যে রেলপথ, স্থলবন্দর ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ সহ মুজিবনগরকে বিশ্বমানের করার ঘোষণা এসেছে। এখন মেহেরপুরবাসী তাদের কাঙ্খিত ওই সমস্ত ঘোষণার দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।
কারণ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের ঐতিহাসিক বৈদ্যনাথতলা একটি আমবাগানে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ, স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠ এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা না হলে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশের নাম লেখা হতো না।
তাই ইতিহাসে মেহেরপুরের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়। ওইদিন বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। সেই মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি হোন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাম ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গতাজ হিসেবে খ্যাত তাজউদ্দিন আহমেদ।
সেই মুজিবনগর সরকার ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন করে। কিন্তু স্বাধীনতার তীর্থস্থান মুজিবনগর মেহেরপুর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দ্বন্দ্বের কারণে উন্নয়নে পিছিয়ে পড়ে সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত একটি জেলাতে পরিণত হয়।
গত ১৫ বছর অনগ্রসর মেহেরপুর আবার এগিয়ে যাচ্ছে। এখন ঘোষণার মৌলিক উন্নয়নগুলোর বাস্তবায়ন রূপ পেলে আর পিছনে তাকাতে হবে না মেহেরপুরকে।
এখানে রেলপথ, স্থলবন্দর বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, আইসিটি পল্লী, মেরিন একাডেমী, মেডিকেল কলেজ স্থাপনের ঘোষণা দীর্ঘদিনের। এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান সমস্যা বেকারত্ব। বেকারত্বের গ্লানি মুছে শিল্পে অগ্রসর হতে ঘোষণাগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই মুজিবনগর মেহেরপুর জেলাবাসী।
মেহেরপুর জেলা “গ” শ্রেণী থেকে উন্নীত হয়ে “খ” শ্রেণীতে মর্যাদা লাভ করেছে। বর্তমান সরকার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বিবেচনায় নিয়ে মেহেরপুরকে এই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু মেহেরপুর জেলা ঘোষণার এই দিনটি প্রতিবারের মত এবারও নীরবেই চলে গেল।
এ প্রসঙ্গে মেহেরপুর অরণি থিয়েটার এর সভাপতি ও সংগঠক নিশান সাবের বলেন, মেহেরপুর মুক্ত দিবস যেমন আনন্দের, ঠিক তেমনি মেহেরপুরজেলা ঘোষণা দিবসটিও মেহেরপুরবাসীর জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের। উদযাপনের মধ্যদিয়ে এদিনগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত বহন করতে হলে এবং নতুন প্রজন্মকে নাড়ির খবর জানাতে হলে আমি মনে করি কমর্সূচি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে মেহেরপুর মুক্ত এবং মেহেরপুর জেলা ঘোষণার মত গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি দিবস নিয়ে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কোনো ধরনের আয়োজন চোখে পড়ে না। আগামীতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এই দুটি দিবস গুরুত্ব পাবে বলে আমি আশা রাখছি। কারণ সব প্রাপ্তি ভুলে যাওয়া যায় না, এবং ভুলে যেতেও নেই।
জ/আ