দেশের দক্ষিণ পশ্চিমের শেষ জেলা সাতক্ষীরা। এ জেলার একেবারে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে রয়েছে সুন্দরবনের দীর্ঘ অংশ। সীমান্তের রায়মঙ্গল, মাহমুদা, মালঞ্চ, আড়পাঙ্গাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি বড় নদী ও অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন খাল রয়েছে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায়। এসব নদী ও খালের দুই পাড়ে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করে প্রকৃতিপ্রেমীদের। এছাড়া মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।
বাংলাদেশের ছয় জেলা জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন। তবে সড়ক পথে সরাসরি বাসে সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত এলেই দেখা যায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ এই বন। একসময় বছরে কয়েক লাখ পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করলেও বর্তমানে সে সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমেছে।
২০২০ সালে করোনা মহামারির পর থেকে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে নানান কারণে পর্যটকের সংখ্যা কমছে। তার ওপর সুন্দরবনে প্রবেশে ব্যয় বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েক গুণ। এ কারণে অনেক পর্যটক সুন্দরবনে আসতে আগ্রহী হন না। এছাড়া পর্যাপ্ত হোটেল-মোটেল ও আধুনিক জলযান না থাকায় এই রেঞ্জে পর্যটকদের আগমন দিন দিন কমছে। এতে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল উপকূলীয় এলাকার হাজারও মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়েছে। অনেক ট্যুর অপারেটর এরই মধ্যে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় বেসরকারি সংস্থার দুটি রিসোর্ট থাকলেও নতুন করে কোনো রিসোর্ট বা আবাসিক হোটেল গড়ে উঠছে না। ফলে পর্যটকদের নিরাপদ আবাসিক ব্যবস্থারও সংকটও রয়েছে। এছাড়া এখানকার নদীতে বড় কোনো লঞ্চ চলাচল করে না।
সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় বেসরকারি সংস্থার দুটি রিসোর্ট থাকলেও নতুন করে কোনো রিসোর্ট বা আবাসিক হোটেল গড়ে উঠছে না। ফলে পর্যটকদের নিরাপদ আবাসিক ব্যবস্থারও সংকটও রয়েছে। এছাড়া এখানকার নদীতে বড় কোনো লঞ্চ চলাচল করে না। ছোট ট্রলারে পরিবার নিয়ে সুন্দরবনে যেতে অধিকাংশ পর্যটক আগ্রহী হন না।
নতুন করে নির্ধারিত ভ্রমণ ফি অনুযায়ী সুন্দরবনের পাশে কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে একদিনের ভ্রমণের জন্য একজনকে (১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ) ১৭২ টাকা ফি দিতে হয়। এছাড়া সুন্দরবনের ভেতরে কটকা, কচিখালী, নীলকমল, হিরণ পয়েন্ট, নোটাবেকী, পুষ্পকাঠী, মান্দারবাড়িয়া, হলদেবুনিয়ার মতো অভয়ারণ্য এলাকায় ভ্রমণের জন্য দেশি পর্যটকদের দৈনিক ভ্রমণ ফি ৩০০ টাকা। বিদেশি পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ ফি ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। সেই হিসাবে তিন দিনের প্যাকেজে একজন দেশি পর্যটককে শুধু সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য ভ্রমণ ফি দিতে হচ্ছে ৯৪৫ টাকা। এর সঙ্গে লঞ্চ ভাড়া, খাবার, গাইড, সিকিউরিটি ফি, অবস্থান ফিসহ নানান খরচ যুক্ত হয়।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালের ১৯ মার্চ থেকে সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল বনবিভাগ। নির্দেশনার সাত মাস পর অক্টোবরে তা তুলে নেওয়া হয়। পরের বছর এপ্রিলের গোড়াতে দেশের অন্যান্য পর্যটন স্থানের মতো সুন্দরবনেও পর্যটক প্রবেশে কিছুদিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া প্রতি বছর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকে।
বন বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জ হয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন ৫২ হাজার দেশি ও ৫০ জন বিদেশি পর্যটক। যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছেন মাত্র ৪১ হাজার দেশি ও ১৮০ জন বিদেশি পর্যটক। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পর্যটকের সংখ্যা আরও কম। চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই রেঞ্জ দিয়ে পর্যটক এসেছে মাত্র ছয় হাজার জন।
পশ্চিম সুন্দরবনের মুন্সিগঞ্জ ও নীল ডুমুর এলাকার ট্রলার মালিক ও ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা মহামারির আগেও শীত মৌসুমে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে আসতেন। তখন পদ্মা সেতুও চালু হয়নি। তারা আশা করতেন সেতু হয়ে গেলে পর্যটক বাড়বে। তবে নানান কারণে পর্যটক বাড়ছে না। এর মধ্যে রয়েছে- জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী, দ্বিগুণ পরিমাণ রাজস্ব বৃদ্ধি এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে নতুন করে কর আরোপ করায় সুন্দরবন ভ্রমণের খরচ বেড়েছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে ছাত্র আন্দোলন, সরকার পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও পর্যটকরা সুন্দরবন আসছেন না। এছাড়া সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের বেহাল দশা, ভালো মানের হোটেল ও বড় লঞ্চ না থাকায় এই রেঞ্জে পর্যটক কমছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বিকল্প হিসেবে পর্যটন খাতে এখানকার অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বেহাল রাস্তা, সুন্দরবন ভ্রমণে খরচ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে পর্যটকের আগমন কমে গেছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন বুড়িগোয়ালীনী এলাকার বাসিন্দা ইমন বলেন, করোনা মহামারির আগেও এই অঞ্চলে হাজার হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে আসতেন। এখন সীমিত কিছু মানুষ সুন্দরবন দেখতে আসে। দিন দিন সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে পর্যটক কমে যাচ্ছে।
উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বিকল্প হিসেবে পর্যটন খাতে এখানকার অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বেহাল রাস্তা, সুন্দরবন ভ্রমণে খরচ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে পর্যটকের আগমন কমে গেছে।
সুন্দরবন রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক গাজী সালাউদ্দিন বাপ্পি বলেন, সাতক্ষীরা থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত সড়কের বেহাল দশা। এছাড়া সুন্দরবনে ঘোরার জন্য ট্রলার ছাড়া ভালো কোনো আধুনিক মানের লঞ্চ সার্ভিস নেই। রাত্রিযাপনের জন্য ভালো কোনো হোটেল নেই। সুন্দরবন ভ্রমণে আগের তুলনায় খরচও বেড়েছে। এসব কারণে দিন দিন কমছে পর্যটক।
সাতক্ষীরা অঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে পর্যটক কমে যাওয়ায় পর্যটন ব্যবসায়ী, গাইড, ট্রলার মালিক ও স্থানীয় হোটেল রেস্তোরাঁর মালিকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। নতুন করে কোনো ব্যবসায়ী এ খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
সুন্দরবনের ট্যুরিজম খাতের ব্যবসায়ী মো. মিজান মোল্লা বলেন, ‘হাউজ বোটসহ মোট তিনটি ট্রলার রয়েছে আমার। এর মধ্যে দুটি ট্রলার গহিন সুন্দরবনে ভ্রমণ উপযোগী। ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এসব ট্রলার তৈরি করেছি। কিন্তু এখানে পর্যটক কম। যারা আসছেন তাদের অধিকাংশ একদিনের জন্য কলাগাছিয়া ভ্রমণ করেন। এছাড়া সুন্দরবন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বছরে প্রায় তিন মাস এসব ট্রলার ফেলে রাখতে হয়। এতে আর্থিক লোকসান হচ্ছে।’
মুন্সিগঞ্জ ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আনিছুর রহমান বলেন, ‘তিন বছর আগে ১০ লাখ টাকা দিয়ে ট্যুরিস্ট ট্রলার তৈরি করেছি। এরপর করোনা মহামারিসহ নানান কারণে পর্যটক কম আসায় ব্যবসা করতে পারিনি। পড়ে থেকে থেকে ট্রলারটি নষ্ট হয়ে যায়। কিছুদিন আগে সেটি বিক্রি করে দিয়েছি। বর্তমানে এখানে কেউ নতুন ট্রলার তৈরি করছেন না। এখানে বিনিয়োগ করে লোকসান হচ্ছে। তারপরও এখনো কিছু ট্রলার নিয়মিত চলছে।’
‘সুন্দরবনের প্রবেশ ফি বাড়ানো-কমানোর বিষয় সরকার নির্ধারণ করে। পর্যটকরা সরকার নির্ধারিত ফি দিয়েই সুন্দরবনে যেতে আগ্রহী। অন্য দুই রেঞ্জ খুলনা ও শরণখোলা দিয়ে বিপুল সংখ্যক পর্যটক প্রতিদিন সুন্দরবন ভ্রমণ করছেন।’- সাতক্ষীরা রেঞ্জের এসিএফ মশিউর রহমান
আনিছুর রহমান বলেন, ‘এ বছর কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে ভাড়ায় খুলনা থেকে একটি বড় লঞ্চ নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু পর্যাপ্ত সংখ্যক পর্যটক না আসায় লোকসান হচ্ছিল বলে সেটা আবার ফেরত পাঠিয়েছি। বর্তমানে কারও ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। যারা ঘুরতে আসছেন তাদের অধিকাংশই একদিনের জন্য কলাগাছিয়া ঘুরে ফিরে যাচ্ছেন। এখনো তিন মাস সিজন আছে। আশা করছি শীত কমলে জানুয়ারির শেষে ও ফেব্রুয়ারিতে প্রচুর পর্যটক এই রেঞ্জ হয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করবেন।’
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মশিউর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর এই রেঞ্জে বিপুল পর্যটক আসতে পারে এমন চিন্তা থেকে বন বিভাগ এখানকার অবকাঠামো নির্মাণে কিছু প্রকল্প নেয়। এর মধ্যে কলাগাছিয়া ও দোবেকি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে নতুন ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, কংক্রিটের ট্রেইল নির্মাণ, কুমির, হরিণের শেড নির্মাণসহ বেশকিছু কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের নৌযানে ওঠার সুবিধার্থে মুন্সিগঞ্জ ও কলাগাছিয়ায় নতুন জেটি স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া এখন অনলাইনে সুন্দরবনে প্রবেশের পাস (অনুমতিপত্র) করা যাচ্ছে। কিন্তু সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের সমস্যার কারণে এদিকে পর্যটকরা আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তাছাড়া এই এলাকায় পর্যাপ্ত হোটেল ও ভালো মানের নৌযান নেই। এ বিষয়ে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে বন বিভাগ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
সুন্দরবনে প্রবেশ ফি বাড়ানোর বিষয়ে মশিউর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনের প্রবেশ ফি বাড়ানো-কমানোর বিষয় সরকার নির্ধারণ করে। পর্যটকরা সরকার নির্ধারিত ফি দিয়েই সুন্দরবনে যেতে আগ্রহী। অন্য দুই রেঞ্জ খুলনা ও শরণখোলা দিয়ে প্রচুর পর্যটক প্রতিদিন সুন্দরবন ভ্রমণ করছেন।’