শনিবার ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
 

মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ    আলোকসজ্জায় সেজেছে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ    বাজারে কাটছে না সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট    ২৯ দিনে ভারত থেকে এলো ৩৫ হাজার ৪৩ টন চাল    দেশের অস্তিত্ব-সার্বভৌমত্ব নষ্ট করেছে শেখ মুজিব: সারজিস    সৌদিতে তাপমাত্রা নামতে পারে মাইনাস ৩ ডিগ্রিতে     ভারতকে ‘অসহযোগী’ দেশ ঘোষণা করলো যুক্তরাষ্ট্র   
এগারো লাখ গ্রাহকের বিমা দাবি নিষ্পত্তি অনিশ্চিত
খন্দকার হানিফ রাজা
প্রকাশ: শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৪, ৯:০১ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের চার ভাগের একভাগ জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান আর্থিক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত হওয়ায় পুরো খাতটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এই সংকটের জন্য অপরিকল্পিত ও মন্দ বিনিয়োগ, এজেন্টদের উচ্চহারের কমিশন নেয়া ও অত্যাধিক ব্যবস্থাপনা খরচকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্যানুযায়ী, দেশের ৩৬টি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩১টির প্রায় ১১ লাখ বিমাকারীর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় তিন হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে গ্রাহকরা কবে তাদের টাকা ফেরত পাবেন তা নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাঁচ বছরযাবত জমে থাকা অমীমাংসিত দাবি এই সময়ের মোট দাবির ৬৬ দশমিক ২১ শতাংশ।

আইডিআরএর তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জীবন বিমাকারীদের দাবি নিষ্পত্তির হার কমেছে। ২০২০ সালে যা ছিল ৮৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা ৭২ শতাংশে নেমে এসেছে। নিষ্পত্তিযোগ্য দাবি থাকা ৩১ বিমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নয়টিরই নিষ্পত্তির হার সবচেয়ে কম। এর মধ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এককভাবে দুই হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা বিমা দাবি থাকলেও পরিশোধ করেছে মাত্র ৩২ কোটি টাকা।

গত ২০২১ সালের এপ্রিলে সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানিকে দিয়ে আইডিআরএর পরিচালিত নিরীক্ষায় ফারইস্ট ইন্সুরেন্সে আত্মসাৎ করা টাকার পরিমাণ দুই হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। আরও ৪৩২ কোটি টাকার হিসাবে অনিয়ম পাওয়া গেছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই টাকা মূলত দুইভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রথমত, বাজারদামের তুলনায় বেশি টাকায় জমি কেনা। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানটির মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিপ্ট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে নেয়া ব্যাংক ঋণ। এমটিডিআর হচ্ছে এমন ব্যবস্থা যেখানে মুদারাবা অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জমা রাখা টাকার ওপর মুনাফা দেওয়া হয়।

এ ধরণের ব্যাপক অনিয়ম ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বায়রা লাইফ ইনসিওরেন্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোয় আছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়ে বলেন, অপরিকল্পিত বিনিয়োগ, এজেন্টকে নিয়মের বাইরে গিয়ে উচ্চহারে কমিশন দেওয়া ও অফিস ব্যবস্থাপনায় বেশি খরচ বিমা তহবিল কমানোর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক ও আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বড় ধরণের কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ও এই খাতের ক্ষতি করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোয় নতুন বিনিয়োগ ছাড়া কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তারা।

আইডিআরএর তথ্য জানা যায়, অধিকাংশ জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ। পদ্মা ইসলামী লাইফ ২২৬ কোটি টাকা দাবির বিপরীতে মাত্র চার কোটি, প্রগ্রেসিভ লাইফ ১৭৪ কোটি টাকা দাবির মধ্যে ছয় কোটি টাকা, সানফ্লাওয়ার ১৪১ কোটি টাকার মধ্যে দুই কোটি টাকা ও বায়রা ৬৭ কোটি টাকার মধ্যে ২ কোটি টাকা দাবি নিষ্পত্তি করেছে। সানলাইফ ইনসিওরেন্স ৬৪ কোটি টাকার দাবির বিপরীতে তিন কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৮৬ কোটি টাকা দাবির মধ্যে নিষ্পত্তি করেছে ৫০ কোটি টাকা। এই পাঁচ বছরে গোল্ডেন লাইফ ইনসিওরেন্স ৩৭ কোটি টাকা দাবির বিপরীতে গ্রাহকদের এক কোটি টাকা ও হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স ২৫ কোটি টাকা দাবির বিপরীতে চার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। আলফা ইসলামী লাইফ, এলআইসি বাংলাদেশ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ও ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ তাদের সব বিমা দাবি নিষ্পত্তি করেছে বলে দাবি করেন। বীমা আইন ২০১০ অনুসারে, বিমা দাবি ম্যাচিউর হওয়ার পর প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে।

এদিকে, বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, তারা তাদের সম্পদ বিক্রির পরিকল্পনা করছে। এফডিআর ভাঙার পাশাপাশি পরিচালন খরচ কমিয়ে অমীমাংসিত দাবি পরিশোধের চেষ্টা করছে। 

বহুজাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ২০ বছরেরও বেশি সময় কাজ করা এক বাংলাদেশি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও জীবন বিমা বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করা হয়েছে। েেদশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বিমা প্রতিষ্ঠান আছে। অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতার অভাব এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। বিমা পলিসি বহুমুখীকরণ করতে হবে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও ব্যবস্থাপনা খরচ কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। দুর্বল বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ আইডিআরএর তত্ত্বাবধানে একীভূত করে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ ও সচ্ছল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শও দেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের দাবি নিষ্পত্তির হার ৪০ শতাংশের নিচে সেগুলোকে পর্যায়ক্রমে বাদ দেয়া উচিত। তবে একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ করা হলে ভালো প্রতিষ্ঠানকে খারাপে পরিণত করবে। অনিয়ম রোধে দায়ী ব্যক্তিদের জরিমানা করা দরকার বলে জানান তিনি।

এদিকে, এ প্রসঙ্গে আইডিআরএর মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দুইটি বড় বিকল্প আছে। হয় প্রশাসক নিয়োগ নয়তো প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা। সরকারের সুনাম বিবেচনা করে নিবন্ধন বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যায় না। আর্থিক অনিয়মে জড়িত পরিচালকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে টাকা উদ্ধারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফারইস্ট, পদ্মা, প্রগতিশীল, সূর্যমুখী ও বায়রা লাইফে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদকে নিয়মিত বৈঠকে ডাকা হচ্ছে। নতুন তহবিল সংগ্রহের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাবি নিষ্পত্তির জন্য স্থায়ী সম্পদ বিক্রির নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আর্থিক অস্থিতিশীলতা রোধে তুলনামূলক স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে।


« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আক্তার হোসেন রিন্টু
বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ : প্রকাশক কর্তৃক ৮২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক (৩য় তলা) ওয়্যারলেস মোড়, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।
বার্তা বিভাগ : +8802-58316172. বাণিজ্যিক বিভাগ : +8801868-173008, E-mail: dailyjobabdihi@gmail.com
কপিরাইট © দৈনিক জবাবদিহি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft