শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ৭ বৈশাখ ১৪৩১
 

ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা    পানির নিচে দুবাই বিমানবন্দর, ব্যাপক বিশৃঙ্খলা    ইরানের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো    মধ্যপ্রাচ্যের পরবর্তী পরিস্থিতিতে নজর রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর    তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪২ ডিগ্রিতে: আবহাওয়া অফিস     ২৩ মে পর্যন্ত জামিন পেলেন ড. ইউনূস    দীর্ঘ ছুটি শেষে রাজধানী ফিরছেন কর্মজীবী মানুষ   
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা ও সম্ভাবনা
নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রকাশ: শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২২, ১০:০৪ অপরাহ্ন

বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এদেশের প্রায় ৮০ ভাগ লোক নিজের কর্তব্য ও কর্ম সম্পর্কে সচেতন নয়। ব্যক্তি যদি নিজ সম্পর্কে সচেতন না হয়, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে না পারে, সেখানে নতুন কিছু আশা করা যায় না। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি বলে প্রতীয়মান হয়। অনেক নতুন নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে, বাস্তবায়নও করা হচ্ছে। কিন্তু আউটপুট অর্থাৎ বাস্তবফল কতটুকু অর্জন হচ্ছে সেটিই আজকের বিবেচ্য বিষয়। 

প্রাথমিক শিক্ষায় ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন আবশ্যক। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় শতকরা ২০ শিক্ষার্থী এই প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো অর্জন করতে পারছে কিনা এই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের মস্তবড় বাধা এদেশের নিম্ন আর্থসামাজিক মানদন্ড ও কর্মে নিযুক্ত পেশাজীবীদের নেতিবাচক মানসিকতা। 

বাংলাদেশে এমন বহু পরিবার রয়েছে, যারা শিক্ষার মৌল বিষয় সম্পর্কে আদৌ সচেতন নয়। বিপুল জনসংখ্যার বিভিন্নমুখী প্রভাব, কুসংস্কার, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তির কারণে এদেশের মানুষ দিন দিন এক নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। 

বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন নয়। মন- মানসিকতার বিচারেও এদের সুস্থ ধরা যায় না। অতিরিক্ত জনসংখ্যা যে কোন উন্নয়ন কর্মকান্ডে বড় বাধা। তার ওপর রয়েছে পারিপার্শ্বিক প্রভাব। 

অন্যের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হওয়া, অতীত প্রেক্ষাপটের সঙ্গেমিল খুঁজে না পাওয়া, নিজের উন্নতির কথা না ভেবে অন্যের ক্ষতির চেষ্টায় লিপ্ত থাকা- ইত্যাদি বিষয় আমাদেরকে জাতি হিসাবে উপরে স্থান করে নেবার সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। 

কোনো প্রান্তিকচাষি কিংবা শ্রমজীবীর সন্তান বিশেষত সুন্দরী কন্যাসন্তান থাকলে অথবা দেখতে যদি বড় দেখায় পঞ্চম শ্রেণীর দোরগোড়ায় পৌঁছতে না পৌঁছতে পৃথিবীর কুৎসিততম রূপ তার সামনে উপস্থাপিত হয়। 

অশিক্ষিত ও কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষের প্রভাবে তখন একটাই আবহ তৈরি হয়- লেখাপড়া করে কী হবে? বিয়ে ও অর্থের বিষয়ই প্রাধান্য লাভ করে। বিয়ে ও অর্থের কারণে অনেকক্ষেত্রে মেয়েদের জীবনবলি দিতে হয়। 

এই হলো বাস্তবতা। এতো গেল কিছু সংখ্যক ফিরিস্তি। আবার কিছু সংখ্যক শির্ক্ষাথী আছে যারা তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো ঠিকভাবে পূরণ করতে পারে না। ফলে শিশুর বিকশিত হবার যে স্তর তা বাধাপ্রাপ্ত হয়। 

অপুষ্টির কারণে ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে পড়ে। অপুষ্টির কারণে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় শিশু আক্রান্ত হয়। আর ইন্দ্রিয়ের অকার্যকারিতার জন্য অনেক সময় শিক্ষক শ্রেণীতে যা পাঠদান করেন তা শিক্ষার্থীর কাছে বোধগম্য হয় না। 

ফলে ক্রমশ শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ে। এই পিছিয়ে পড়ার পেছনে আবার হতাশাও কাজ করে। প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। একজন শিক্ষার্থী যখন একই শ্রেণীতে তিন/চার বছর পুনরাবৃত্তি হিসাবে থাকে তখন শিক্ষাজীবনই তার কাছে একঘেয়ে ঠেকে।

 ফলে বিদ্যালয় পরিবেশ বাদ দিয়ে সে কোথাও কাজ করে, অর্থ উপার্জনকে শ্রেয় মনে করে। এছাড়া বয়সের সাথে শ্রেণীর সঙ্গতি না থাকলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে। 

দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের কারণে সমাজ ও পরিবারে নানাবিধ সমস্যা ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। ফলে বেশিরভাগ পরিবারে দ্ব›দ্ব ও কলহ বিরাজ করে; যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। শিক্ষার্থীর চিন্তা চেতনায় অনেকক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোই আবর্তিত হয়। 

শিক্ষা সম্পৃক্ত বিষয় তার কাছে উপযোগিতা পায় না। শ্রেণীকক্ষে বসেও শিক্ষার্থী অনেক সময় পারিবারিক পরিবেশের অবাঞ্ছিত মুহূর্তগুলো তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু করে নেয়। শিক্ষকের পাঠদান তার ভেতরে সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। 

ফলে পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীর দূরত্ব বাড়ে। অতি মেধাবী, চঞ্চল ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা যদি মেধা অনুযায়ী শিখন পরিবেশ না পায় সেক্ষেত্রেও বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। 

বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও সহযোগিতার জন্য যে ম্যানেজিং কমিটি থাকে তাও অনেক সময় ক্ষুদ্র কোন বিষয়ে ইস্যু তৈরি করে বিশাল সমস্যায় পরিণত করে। ফলে শিক্ষকরা অনেক সময় অবাঞ্ছিত ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। 

অনেক শিক্ষক আছেন সম্মান হারানোর ভয়ে সঠিক কথা বলতে পারেননা। যে শিক্ষক সমাজে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র সেই শিক্ষককে অপমান হতে হয় ব্যবস্থাপনা কমিটির শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ব্যক্তির কাছে। যে শিক্ষকের মাথা উঁচু করে থাকার কথা সেই শিক্ষককে সইতে হয় অপমান আর গ্লানি। 

বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকান্ডে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাতের জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা অনেক সময় বিদ্যালয়ে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি তৈরি করেন। অনেক সময় এতে শিক্ষক নামের কলংকরূপী কিছু শিক্ষকের যোগসাজশও থাকে। 

ফলে স্কুলের আর উন্নয়ন হয় না। উন্নয়ন হয় ব্যবহারকারীর উদরের। এই উদর এতো বিশাল যে কখনো ক্ষুধা নিবৃত্তি ঘটেনা। তবে বিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির ইতিবাচক দৃষ্টান্তও আছে আমাদের দেশে। 

যার প্রেক্ষিতে বিদ্যালয় অবিরত উদ্দেশ্যও লক্ষ্যের পথে এগিয়ে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এবার কর্মে নিযুক্ত পেশাজীবীদের নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে একজন পরামর্শদাতার একটি উক্তি উল্লেখ করতে চাই। এক মধ্যাহ্নে আমরা কয়েকজন প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। 

তখন তিনি যে কথাটি বললেন মনে হলো এর চেয়ে বড়ো সত্যটি আর কিছু নেই। তিনি বলেছিলেন, এখানে যারা পেশাজীবী হিসাবে যারা আছেন তারাই আবার প্রাথমিক শিক্ষার সফল বাস্তবায়নে বাধা হিসাবে কাজ করে। কথাটি শুনতে সত্যিই খারাপ লাগে। 

কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সবার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্যও নয়। শিক্ষাদান করার ক্ষেত্রে শিক্ষকের যে আয়োজন থাকার কথা তার প্রতিফলন কি সব স্কুলে সব শিক্ষক ঘটান? উত্তর অবশ্যই আশাব্যঞ্জক হবে না। প্রতিটি স্কুলে উপকরণ সরবরাহ করা হয়। 

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দেশনা অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন হয় না। কোথায় যেন অনাদরের চিহ্ন রয়ে যায়। এই সত্যিটা উল্লেখ করলে সংশ্লিষ্ট কর্মে নিযুক্ত পেশাজীবীরা আবার ক্ষেপে ওঠেন। নিজের গায়ের গন্ধ নিজের নাকে লাগে না। 

যেন মানুষ সব দোষের ঊর্ধ্বে। তারা তো কোন অন্যায় করতে পারেনা। যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেই বলছিÑ ক’জন শিক্ষক নিজের কর্মের আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মউপলব্দি করেন? ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শ্রেণী পরিদর্শন করবেন। সেজন্য উপকরণ ও পাঠ পরিকল্পনা ক্লাসে নিতে হবে। 

স্বভাবত প্রশ্ন জাগে-তাহলে অন্য সময় ? অন্যসময়ের গুরুত্ব কি বৃথা যাবে ?বিষয়টি কি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পাঠ দেওয়া হবে?না শিক্ষার্থীকে? যদি শিক্ষার্থীর উদ্দেশ্যে পাঠ দেওয়ার কথা থাকে তাহলে তো সেটা চলমান থাকার কথা। তবে সবক্ষেত্রে এই বক্তব্য সঠিক নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বিষয় গুলো দৃষ্টিগোচর হয়।

এছাড়া পেশার প্রতি আন্তরিকতা কর্মের মানকে বহুগুণ সমৃদ্ধ করে। করার আছে করলাম; দায়সারা গোছের কর্ম সঠিক পথ তৈরি করতে পাওে না। শিক্ষকতার ক্ষেত্রেও আন্তরিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আন্তরিকতা দিয়ে অনেক অসাধ্য কাজও সম্পন্ন করা যায়। শিক্ষকরা পেশার প্রতি কতটা আন্তরিক তা দেখা যায় তার কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে। 

এমনও দেখা যায় দশ/বারজন শিক্ষকের মধ্যে দুই/তিন জন যদি নিয়ম অনুযায়ী চলে তবে অন্যরা অনেক সময় খোঁচা মারা কিংবা টিটকারী করতে ভুলেন না। কোথায় প্রেরণা, সাহস ও প্রশংসা করবে তা না করে যা তারা করেন অনেক ক্ষেত্রে রুচিহীনতার বহিঃপ্রকাশই ঘটে। এছাড়া অনেকে রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগান। 

যখন যে দল ক্ষমতায় থাকেন তখন তারা সে দলের পরিচয় দিয়ে হোমরা চোমরা বনে যান। এই কারণে শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করেন না। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশনা মানেন না। স্কুলের নিকটবর্তী চা-দোকানগুলোতে ঝড় তোলেন। বিদ্যালয়ের ইতিবাচক পরিবেশকে বাইরে নেতিবাচক হিসাবে উপস্থাপন করেন। ফলে স্কুলের সঙ্গে এলাকার জনগণের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, যা স্কুলের সুন্দর পরিবেশের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। 

কিছু সংখ্যক শিক্ষক নিয়মও নির্দেশনার খুব একটা তোয়াক্কা করেন না। সামান্য বিষয়কে বিশাল আকারে তৈরি করে তিক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে অনেক পেশাজীবীর জুড়ি মেলা ভার। অনেক শিক্ষকের মনে নেতিবাচক ধারণাগুলো এতো বিশাল আকারে শিকড় গজায় যে, তাদের দিয়ে সঠিক দায়িত্ব পালন আশা করা যায়না। তারা মনে করেন-তারা যা ভাবেন তা সঠিক, অন্যদের ভাবনা ভুলে ভরা। 

ভুলের মধ্যে থেকেই তাদের পেশা জীবন শেষ করে দেয়। অথচ এটা জানা কথা যে,  নিয়ম ও শৃঙ্খলাই মানুষকে মুক্তি দেয় ও কল্যাণের পথে এগিয়ে নেয়। কাজেই যে নির্দেশনাগুলো শ্রেণীর পাঠদান কাজে সহায়ক তা সব শিক্ষকের অনুসরণ করা উচিত; তবে তা ক্ষমতা অনুযায়ী। বোঝা যদি বেড়ে যায়, তবে সে বহনের ক্ষমতা অনেকের থাকে না। 

আবার কিছু শিক্ষক আছেন- পেশাগত জীবনের চেয়ে নিজের ব্যক্তিজীবনকে বেশি প্রাধান্য দেন। ফলে গল্প-আড্ডা ও উপরি পাওয়ার বিষয়গুলো তাদের মনে স্থান পায় বেশি। শ্রেণীর পাঠদান প্রক্রিয়া সফল করার বিষয়টা হয়তো তাদের মনেই থাকে না। 

শিক্ষক ক্লাসে গিয়ে শুধু শিক্ষার্থীদের কাজই দিল- কিন্তু বিষয়ের ধারণা দিল না- তাহলে শিক্ষার্থী বিষয়টা বুঝবে কীভাবে? বিষয়ের উপস্থাপনা যদি শিক্ষার্থীর মনে চিন্তার ডানা না মেলে তবে তো যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরে রয়ে যাবে। 

অনেক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বলতে শোনা যায়- এগুলো একেবারে গাধা। স্বীকার করি এরা গাধা। কিন্তু গাধাকে তো জল খাবার দিতে হবে। না হয় বোঝা টানবে কীভাবে। তবে এটা ধ্রূব সত্য- বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আর্থসামজিক অবস্থার কারণে যথাযথ সাড়া দেয় না যা অনেক সময় শিক্ষককে হতাশায় নিমজ্জিত করে। শিক্ষক শুধু পড়িয়ে যাবেন, পরিশ্রম করে যাবেন, সে অনুযায়ী ফল না এলে কষ্ট লাগারই কথা।

বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের গৃহে শিক্ষার যে তদারকি ব্যবস্থা চালু থাকার কথা তা পরিচালিত হয় না। মা, বাবা, বড় ভাই, বোন অনেক সময় খোঁজ খবর ও রাখে না। পিতা- মাতা মনে করে, জন্ম দেওয়ার কাজ ছিল জন্ম দিলাম। মানুষ করার দায়িত্ব শিক্ষকের। 

শিক্ষক দিক-নির্দেশনা দিতে পারেন, পাঠ্য বিষয় বোধগম্য করে দিতে পারেন, প্রকৃত মানুষ হবার জন্য অনুপ্রাণিত ও উজ্জ্বীবিত করতে পারেন; কিন্তু শিক্ষা অর্জনের প্রাথমিক স্তর হলো পরিবার। পরিবার থেকে যদি শিক্ষার্থী আচরণ না-শেখে, মানব চরিত্রের মহৎগুনগুলো না-শেখে, পরিবারেই যদি থাকে অনিয়ম, মিথ্যা, কলহ ও জরাজীর্ণ পরিবেশ-তবে সেই পরিবেশ শিক্ষার্থীর মনে কী প্রভাব ফেলবে তা তো সহজেই অনুমেয়। 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পরিবার থেকে যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা তা পায় না। উপরন্তু পরিবারকে শিক্ষার্থীর সহায়তা করতে হয়। সেটা হতে পারে পাতা কুড়িয়ে, লাকড়ি সংগ্রহ করে কিংবা গৃহস্থালীর অন্যান্য কাজে। 

ফলে শিক্ষার্থী বিদ্যালয় হতে গিয়ে বইগুলো যেভাবে বাড়িতে রাখে আবার বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে সেভাবেই বইগুলো নিয়ে যায়। বাড়িতে অবস্থানকালীন বইগুলো পড়া ও চর্চা করা শিক্ষার্থীর কর্মের পরিসরে পড়ে না। হয়তো খেলাধূলা করে, কাজ করে, ঘুরেফিরে, মারামারি কিংবা কলহ সৃষ্টি করে সময় কাটায়।

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে আরো একটি অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে শিক্ষকদের শিক্ষাবহিভূত কর্মে সম্পৃক্ত করা। ভোটার তালিকা তৈরি, জরিপ, বিভিন্ন তথ্য ছক পুরণ এসব কর্মে শিক্ষকদের ওপর বিরাট চাপ পড়ে। 

এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বুঝা উচিত। একদিকে ছোট ছোট শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন, বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে চলা তার ওপর এতো সব কর্ম এতো নৌকায় পা দিয়ে কোন নৌকায় করে গন্তব্যে যাবেন শিক্ষকরা। 

শিক্ষক সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র। জরিপের কাজে, ভোটার তালিকার কাজে কিংবা অন্য কোনো কাজে যখন বিভিন্ন বাড়িতে গমন করেন তখন অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা অসৌজন্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হন। আমাদের সমাজের প্রায় মানুষের ভাবনাগুলোও অমূলক, যা কল্যাণ ও মঙ্গলের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। 

বিভিন্ন মানুষ ভাবে ও বলে যে, তাদের থেকে তথ্য নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করবে শিক্ষকরা। অনেক সময় এলাকায় বিভ্রান্তিমূলক কথা ছড়িয়ে শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণœ করা হয়। এছাড়া বিদ্যালয় পরিদর্শনে শিক্ষকের অবস্থান, উপবৃত্তি অন্যান্য তথ্য রেকর্ডের ওপর যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, শিক্ষকদের শিখন শেখানো কার্যাবলীর প্রতি সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। 

পরিদর্শনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের শ্রেণী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ণ ও পরামর্শ দান একান্ত জরুরি। প্রশিক্ষণ পরবর্তী কাজের তদারকি কর্মে নতুন মাত্রা যোগ করে। এক্ষেত্রে শিক্ষক ভুল করে থাকলে তা শুধরে নিতে পারেন। 

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সম্পৃক্ত সবাই যদি নেতিবাচক ধারণা পাল্টে ইতিবাচক ধ্যান-ধারণায় এবং কর্মের পথ পরিক্রমায় চলে, তবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যায় আমরা সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো। যে যে বিষয়গুলো শিক্ষকদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে সেই বলয় হতে বেরিয়ে নতুন যাত্রায় উত্তরণ ঘটবে। 

এটা অবশ্যই আশার কথা আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে অনেক যোগ্য লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যোগ্য লোক যদি যোগ্য জায়গায় স্থান না-পায় তবে সেক্ষেত্রেও মরিচা ধরার সন্দেহ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে অনেকে এখানে প্রবেশ করে। পরে নিস্পৃহ হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায় আলোর আলোক কণাগুলো। 

এই আলোর বিন্দুগুলোকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। এদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। বিকশিত করার জন্য অবস্থান তৈরি করতে হবে। তবেই অগ্নিবিন্দু শিখায় শিখায় আলো ছড়াবে। আর এই আলোর সমাহার আমাদের সমৃদ্ধ জাতি হিসাবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে। 

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হলেও এর অগ্রযাত্রা অব্যাহত গতিতে চলছে। বেশকিছু সংখ্যক মানুষের ইচ্ছা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রাথমিক শিক্ষাএগুচ্ছে। 

প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে কর্মরত প্রত্যেকের মনে দেশের প্রতি যদি ভালোবাসা ও মমত্ববোধথাকে, ছোট ছোট শিশুদের আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার দীক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে এদেশ হয়তো অতীতের গ্লানি মুছে ভবিষ্যতের জন্য সোনালি দিন উপহার দিতে পারবে। তখন যদি আমরা পৃথিবীতে নাও থাকি, নাও দেখতে পারি সেই সোনালি প্রভাত, তবুও দুঃখ থাকবে না। কারণ, এই বীজটা যে আমাদের শিক্ষকরাই বুনেছিলেন।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও গবেষক।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. আক্তার হোসেন রিন্টু
বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ : প্রকাশক কর্তৃক ৮২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক (৩য় তলা) ওয়্যারলেস মোড়, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।
বার্তা বিভাগ : +8802-58316172. বাণিজ্যিক বিভাগ : +8801868-173008, E-mail: dailyjobabdihi@gmail.com
কপিরাইট © দৈনিক জবাবদিহি সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft