অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কা। খাদ্য, পানি, জ্বালানী সংকটের কারণে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পরা গণঅভু্যত্থানের মুখে পালিয়েছে সে দেশের পেসিডেন্ট। তবে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কাই নয়, একেবারে এমন অর্থনৈতিক সংকটের গভীর খাদের কিনারে রয়েছে আরো বেশ কিছু দেশ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসংকটের কারণে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের একেবারে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশ।
বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার মতো প্রায় একই পরিণতি হতে পারে লেবানন, সুরিনাম ও জাম্বিয়ার মতো দেশগুলোর। তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো হলো আর্জেন্টিনা, ইউক্রেন, তিউনিসিয়া, ঘানা, মিসর, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, এল সালভাদর, পাকিস্তান, ইকুয়েডর, বেলারুশ ও নাইজেরিয়া। এই দেশগুলোতেও ক্রমবর্ধমান ঋণ, বাণিজ্য ঘাটতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের কবলে রয়েছে।
আর্জেন্টিনা: এমন দেশের তালিকার প্রথমেই রয়েছে এই দেশটি। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আর্জেন্টিনার সার্বভৌম বন্ডের ৫০ শতাংশ খেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছে। দেশটির মুদ্রামানের ভয়াবহ পতন হয়েছে। দেশটির মুদ্রা পেসো এখন ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে কালোবাজারে লেনদেন হচ্ছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার মতো পর্যাপ্ত তহবিল নেই দেশটির হাতে।
নেপাল: ধরা যেতে পারে নেপালের কথা। ক্রমবর্ধমান আমদানির কারণে হিমালয় দেশটি বাণিজ্য ঘাটতিতে আক্রান্ত হয়েছে। ১৬ জুলাই থেকে শুরু হওয়া আর্থিক বছরের প্রথম আট মাসে নেপালের বাণিজ্য ঘাটতি $৯.৫ বিলিয়ন ছুঁয়েছে, যা নেপাল সরকারের সম্পূর্ণ বাজেটের পরিমাণের কাছাকাছি। সমস্যা বাড়িয়েছে রেমিটেন্স কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া।
পাকিস্তান: পাকিস্তানের ছবিও অনেকটা একই রকম। ইসলামাবাদ ইতিমধ্যে একটি বেলআউট প্যাকেজের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। করাচি ভিত্তিক সংবাদপত্র ডন এক সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছে যে আইএমএফ চুক্তিতে আর কোনো বিলম্ব কেবল অর্থনীতির অপরিবর্তনীয় ক্ষতির কারণ হবে না এবং আর্থিক সহায়তার জন্য সৌদি আরব এবং চীনের সাথে আলোচনাকেও প্রভাবিত করবে। জানানো হয়েছে, "এই পরিস্থিতি অস্থিতিশীল।"
ইউক্রেন: রাশিয়ার আগ্রাসনে দেশটি এখন বিপর্যস্ত। দেশটি পুনর্গঠনে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করতে হবে। দেশটির অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে ইতিমধ্যে মর্গান স্ট্যানলি ও আমুন্ডির মতো বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান সতর্ক করেছে। ইতিমধ্যে দেশটি আন্তর্জাতিক বন্ডের পেমেন্ট পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে।
তিউনিসিয়া: সংকটে থাকা তিউনিশিয়া ইতিমধ্যে আইএমএফের দ্বারস্হ হয়েছে। দেশটির বাজেট ঘাটতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। মর্গান স্ট্যানলি তাদের তালিকায় তিউনিশিয়ার নামও রেখেছে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশটি আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে।
ঘানা: আফ্রিকার দেশ ঘানার জিডিপির তুলনায় ঋণের আকার ৮৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে দেশটির মুদ্রামান এক-চতুর্থাংশ কমেছে। দেশটির যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয়, তার অর্ধেক চলে যায় ঋণ পরিশোধে। দেশটির মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ৩০ শতাংশ।
মিশর: মিশরের জিডিপির তুলনায় ঋণের পরিমাণ ৯৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। জেপি মর্গানের হিসাবে, এ বছর দেশটিকে আন্তর্জাতিক ঋণের কিস্তির জন্য ১১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। আগামী পাঁচ বছরে দেশটিকে আরো ১০০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। ইতিমধ্যে দেশটির মুদ্রামান ১৫ শতাংশ কমিয়েছে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে দেশটির।
কেনিয়া: অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে কেনিয়াতেও। দেশটির যত রাজস্ব আদায় হয়, তার ৩০ শতাংশ চলে যায় সুদ পরিশোধে। দেশটির আন্তর্জাতিক বন্ডগুলো দর হারিয়েছে প্রায় অর্ধেক।
এল সালভাদর: বিট কয়েন প্রচলন করে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে দেশটি। এল সালভাদর দেশটির অভ্যন্তরে লেনদেনে বিট কয়েন বৈধ ঘোষণার পর তরতর করে পরে যায় বিট কয়েনের দাম। দেশটির প্রচলিত আন্তর্জাতিক বন্ড ক্রয়ে এখন আস্থা কমে গেছে। পরিস্হিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, স্বল্পমেয়াদি বন্ডগুলো ৩০ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি বন্ডগুলো ৭০ শতাংশ ডিসকাউন্টে বিক্রি করতে পারছে না।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অনেক রাষ্ট্র এখনো তাদের দেউলিয়া হওয়ার পরিস্থিতি এড়াতে পারে, যদি বিশ্ববাজার স্থিতিশীল হয় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যদি তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল অনেক দেশ আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে।
আইএমএফ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডঃ ক্রিস্টালিনা জর্জিভা গত মাসে জানিয়েছেন "বেশিরভাগ উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি কেবল যুদ্ধের অর্থনৈতিক পতনের মুখে পড়েনি, বরং মহামারী সংকটের ফলেও এই ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে চাকরি হারানো এবং শেখার ক্ষতি – বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে মহিলা এবং তরুণরা।
বর্তমান সংকট থেকে শিক্ষা:
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যেসব দেশ জ্বালানি আমদানির উপর নির্ভর করে তাদের আমদানি বিল এমন সময়ে বেড়েছে যখন বিশ্ব অর্থনীতি সবেমাত্র কোভিড-১৯ মহামারীর মারাত্মক প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন যে ভারত, ভারত - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল গ্রাহক তার ৮০ শতাংশেরও বেশি অশোধিত আমদানি করে, সরকারী ব্যয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই "সতর্ক" থাকতে হবে।
এক ব্যক্তি ইন্ডিয়া ন্যারেটিভকে জানিয়েছেন, "আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিশেষ করে যখন পণ্যের দাম বাড়তে থাকে তখন পপুলিস্ট পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকা। ভারতকে অবশ্যই এই ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে, বিশেষ করে এখন যেহেতু বিশ্ব অর্থনীতি অত্যন্ত অস্থির সময়ের মধ্যে রয়েছে বলে তিনি জানান ।
জর্জিয়েভা জানিয়েছেন, সহায়তার মাধ্যমেও, অনেক নীতিনির্ধারক ক্রমবর্ধমান ঋণ মোকাবিলার কঠিন কাজের মুখোমুখি হন। "এ কারণেই ব্যয়কে সাবধানে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের লক্ষ্য করে করা উচিত।"
-জ/আ