কাজ শুরু না করেই ৫ কোটি টাকা প্রকল্পের কাজের ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বিল তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার জহিরুল ইসলাম। আর এ কাজে সহযোগিতা করেছেন এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান। তবে তিনি বলছেন, নিয়ম মেনে বিল দেওয়া হয়েছে।
সূত্র মতে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে মেহেরপুর সদর এলজিইডির তত্ত্বাবধানে উপজেলার বারাদি থেকে পিরোজপুরের জাদুখালি স্কুল পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। মেহেরপুরের মেসার্স জহিরুল লিমিটেডের মালিক জহিরুল ইসলাম রাস্তাটি ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব পান।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৮ মে কাজ শুরু হয়ে শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের ডিসেম্বরে। দেড় বছরের কাজের মাত্র এক মাস যেতে না যেতেই এমনকি কোনো কাজ না করেই ২০২১ সালের ১৪ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৯৭৯০ টাকা বিল পরিশোধ করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী।
কাজ না করেও যে যে খাত উল্লেখ করে বিল প্রদান করা হয় সেগুলো হলো: পিআইইই (৭৫এমএম) ৬৮৪১৮.৯৪ টাকা, ইই (১২৫এমএম) ১৫৯৭১২৬.৩৫ টাকা, বিএন্ডএসবিসি ৬৮৬৮৪.১৪ টাকা, বিসিএন্ড এসজিসি (৪৫০এমএম) ৬৯৩৭২৪.৪৮ টাকা, ডিআইএস (এসবি/বিসি) ৬৮৭৬.৯১ টাকা, এসএন্ডসি (এসবি) ১২৫৫৯.৩৮ টাকা, এসএএন্ডডি (এমএফ০.৫০) ১২৩৬৩১৭.৪৭ টাকা, এসবিবিসি (এফএম-০.৫) ৪০২২৯৬২.১৭ টাকা, এইচবিপিএমএম ৪২৪১৬১.৮১ টাকা, এসবি ৭৯৪৯১.৬০ টাকা, এসএন্ড এসবিসি ১০৯৩৪৭৫৯.৯৫ টাকা, সিডাবলিউ বিএম (আইএসএসএম) ৭৮২১০১.৪৮ টাকা, পিসিএমডি ১.২ : ১৪৫১৭৫৫.৮০ টাকা, ডিসিপিএম ১২৩৩০৮৫৭.৪৬ টাকা প্রদান করা হয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, নির্ধারিত তারিখে কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাস্তাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে ফেলে রাখেন দীর্ঘদিন। এ সময় এলাকার মানুষের ভোগান্তি ছিল। চলতি মাসের ১৪/১৫ তারিখে সেই রাস্তাটিতে বালি ও খোয়া ফেলে প্রথম কাজ শুরু হয়। তারা বলেছেন, মানহীন ইটের খোয়া ও মাটি মিশ্রিত বালি দিয়েই ডাবলিউবিএম করা হয়েছে। এছাড়া ওপরে ভালো করে রুলার করা হয়নি। তড়িঘড়ি করে তারা এই কাজ সম্পন্ন করছেন। এতে রাস্তার মানও খারাপ হবে বলে জানান এলাকাবাসী।
গহরপুর গ্রামের চা দোকানি জহিরুল ইসলাম জানান, রাস্তাটি নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ঝামেলাতে ছিলাম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাস্তা খুঁড়ে ফেলে রেখেছিলেন। ৭/৮ দিন আগে খোয়া ফেলেছেন। ঠিকাদার নিম্নমানের ইট, খোয়া ও মাটি মিশ্রিত বালি ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ করেন তারা।
পিরোজপুর গ্রামের কৃষক মতিয়ার রহমান, টুঙ্গিগোপালপুর গ্রামের শাহাবুল ইসলাম ও বিল্লাল হোসেন জানান, কলাইডাঙ্গা ও গহরপুর গ্রাম এলাকায় রাস্তাটির কাজ ৪/৫ দিন আগে শুরু হয়েছে। তবে ১০/১৫ দিন আগে পিরোজপুর অংশে কাজ শুরু হয়েছে।
সরজমিনে দেখা গেছে, রাস্তায় ডাবলিউবিএমে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের খোয়া ও বালি। রাস্তার পাশের এজিং করার কাজেও ব্যবহার হয়েছে নিম্নমানের ইট। রুলার দিয়ে কমপেকশনের কাজটিও ঠিকমত হচ্ছে না। অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কাজটি শেষ করার চেষ্টা করছে। এত বড় কাজের সাইটে শফিকুল ইসলাম নামের একজন মাত্র ওয়ার্ক অ্যাসিসটেন্ট কাজটি দেখভাল করছেন। সেখানে কোনো প্রকৌশলীর দেখা মেলেনি। রাস্তার দু-পাশে নির্মাণ করা হয়নি কোনো সোল্ডার। এরই মধ্যে পিচের কাজ শুরু করেছেন ঠিকাদার।
মেহেরপুরের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার জাকির হোসেন খান বলেন, রাস্তা টেকসই হওয়ার জন্য ডাবলিউবিএমের ডাবল লেয়ার কমপেকশন করা দরকার। একই সঙ্গে ডাবলিউবিএম করার পর অন্ততপক্ষে দেড় থেকে দুই মাস ফেলে রাখা উচিত। অথচ, ঠিকাদার রাস্তাটি নির্মাণ করছেন তড়িঘড়ি করে। দেখভালের দায়িত্বেও চরম অবহেলা করছেন এলজিইডির কর্মকর্তারা।
মেহেরপুর এলজিইডির ল্যাব ইনচার্জ উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুর রহমান জানান, ওই রাস্তার কাজে যে ইট বা খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে সে ইট বা খোয়া টেস্ট করা হয়নি। কাজের শুরুতে বর্ধিত অংশের খোয়া পরীক্ষা করা হয়েছিল।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের মেহেরপুর সদর উপজেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী নাজমুল হক জানান, আমাকে দিয়ে কাজ না হতেই এই বিলটি করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। আমার বদলি হওয়ার সময় হওয়ায় এই অবৈধ বিলটি করতে অপারগতা প্রকাশ করি।
সদর উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ জানান, আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্বাহী প্রকৌশলী। তিনি যেভাবে বলেছেন, সেটাই করেছি। এখানে বড় বড় মাথাদের বিষয়।
এ ব্যাপারে জহুরুল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী জহিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে, তিনি কোনো কথা না বলে বিষয়টি অফিসের ওপর ছেড়ে দেন।
মেহেরপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামানের কাছে কাজের আগে বিল উত্তোলন করার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নিয়ম মেনেই তাকে বিল প্রদান করেছি। ওই রাস্তার নির্মাণ কাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করার পরই তাকে বিল দেওয়া হয়েছে। আগামী ১০/১৫ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ কাজটি হয়ে যাবে বলেও জানান তিনি। কাজের নির্মাণ সামগ্রী নিম্নমানের হচ্ছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।
-জ/অ
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |