কিয়ামত আরবি শব্দ। অর্থ মহাপ্রলয়, পুনরুত্থান। ইয়াওমুল কিয়ামা—অর্থ কিয়ামতের দিবস। দুনিয়ার সব মানুষ ও জ্বীন জাতিকে একত্রিত করা হবে কিয়ামতের দিন। তাদের সব নেক ও বদ আমলের চূড়ান্ত হিসাব হবে। এর পর হবে জান্নাত ও জাহান্নামের ফয়সালা। যারা জান্নাত লাভ করবে তারা চিরকাল জান্নাতে থাকবে, আর যারা জাহান্নাম লাভ করবে তারা চিরকাল জাহান্নামে অবস্থান করবে। এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন আসে কিয়ামত বা পুনরুত্থান কখন সংঘটিত হবে?
এ প্রসঙ্গে কোরআন-হাদিসে নির্দিষ্ট কোন তারিখ উল্লেখ না থাকলেও এর আলামত সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা কি শুধু এই অপেক্ষায় রয়েছে যে কিয়ামত তাদের কাছে এসে পড়ুক। বস্তুত কিয়ামতের লক্ষণগুলো তো এসেই পড়েছে। সুতরাং এসে পড়লে তারা কীভাবে উপদেশ গ্রহণ করবে? (সূরা : মুহাম্মাদ, আয়াত : ১৮)।
আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘শেষ যুগের উম্মতের এক সম্প্রদায়কে বানর ও শূকরে বিকৃত করে দেয়া হবে।’
সাহাবিরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! তারা কি আল্লাহ এক ও মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল হওয়ার সাক্ষ্য দেয় না?’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ তারা রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এবং হজও আদায় করে।’ সাহাবিরা বললেন, ‘তাহলে তাদের অপরাধ কী?’
নবীজি (সা.) বললেন, ‘তারা ঢাকঢোল, বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা মহিলা বরণ করবে। এই লোকগুলো আমোদ-প্রমোদ ও মদ্যপানে মত্ত অবস্থায় রাত কাটাবে। সকালে দেখা যাবে, তাদের বানর ও শূকরে বিকৃত করে দেয়া হয়েছে।’ (আসবাহানি, হিলয়াতুল আউলিয়া : ৩/১১৯-১২০)।
সাহল বিন সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মাঝে ধ্বংস, পাথরবৃষ্টি এবং চেহারা বিকৃতকরণ শাস্তি আসবে।’ সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘হে রাসূল! কবে এই আজাব আসবে?’
নবীজি (সা.) বললেন, ‘যখন বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা নারীদের খুব বিস্তার ঘটবে আর মদকে হালাল মনে করা হবে।’ (তাবারানি, আলমুজামুল কাবির : ৬/১৫০; তিরমিযি, আসসুনান : ২২১৩; সনদ হাসান)।
কিয়ামতের ছোট আলামতগুলো প্রকাশিত হয় গেলে হঠাত করেই কিয়ামতের বড় আলামতগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করবে। রাসূল (সাঃ) বলেন, মালা ছিড়ে গেলে এর পুতিগুলো যেমন দ্রুত খসে পড়ে ঠিক সেভাবেই কিয়ামতের (বড়) আলামতগুলো একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকবে। (তিরমিযী)
কিয়ামতের বড় আলামতগুলো হচ্ছে: দুখান (ধোঁয়া)। রক্তিম ধোঁয়া, যা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলবে এবং যার প্রভাবে মুমিনদের সামান্য সর্দি-কাশির মত অবস্থা হবে আর কাফেরদের জন্য যা হবে ভয়াবহ আযাব;দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ; হযরত ঈসা (আঃ) এর অবতরন; ইয়াজূজ-মাজূজ;পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়; দাব্বাতুল র্আদ (প্রাণীবিশেষ যা মাটি ভেদ করে বের হবে);তিনটি ভূধ্বস, একটি পূর্ব প্রান্তে, একটি পশ্চিম প্রান্তে আরেকটি জাযীরাতুল আরবে।
কিয়ামতের বড় বড় আলামত এখনো পরিদৃষ্ট না হলেও ছোট ছোট আলামতগুলো এমনভাবে সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে, যা রোধ করার ক্ষমতা কারো নেই। কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান থেকে মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বদদ্বীনি আচরণ ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। মানুষ থেকে নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। হিংসা, লোভ ও অহংকারের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিযোগিতা করে অট্টালিকা নির্মাণ করা হচ্ছে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনের পরিবর্তে দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমনের কার্যক্রম গর্বের সঙ্গে করা হচ্ছে। শিরক, বিদআত, নিফাক ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে, মিথ্যা, আমানতের খিয়ানত, ওয়াদা খিলাফ অহরহ হচ্ছে। সন্তান পিতা-মাতার শুধু অবাধ্য নয়, বরং পিতা-মাতাকে খুন করছে। পিতা-মাতা সন্তানকে আদর-স্নেহ দিয়ে মানুষ করার পরিবর্তে নিজেই হত্যা করছে। যা জাহেলি যুগেও করা হতো না। অন্যায়-অবিচার এত প্রকট আকার ধারণ করেছে যে মানুষ অন্যায়কে অন্যায় মনে করছে না। ন্যায়নীতির পরিবর্তে অন্যায়-জুলুম করা হচ্ছে। নারীরা পর্দা করার পরিবর্তে পর্দাহীনতাকে অহংকারের বিষয় বানিয়ে নিয়েছে। সুদ-ঘুষ, মদ, জিনা-ব্যভিচার বেড়ে গেছে। জাহেলি যুগের মতো সুদকে ব্যবসার ন্যায় হালাল মনে করা হচ্ছে। ঘুষকে স্বাভাবিকভাবে দেখা হচ্ছে। মদপানকে তুচ্ছ করে দেখা হচ্ছে। পাঁচ বছরের বালিকা পর্যন্ত ধর্ষিত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুবতীরা যুবকদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। সমাজে সৎ ও নেককার লোকেরা লাঞ্ছিত হচ্ছে। অসৎ ও দুষ্ট লোকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। বদকর্মে পৃথিবী টইটম্বুর হয়ে যাওয়ার ফলে বলতে হয় কিয়ামত আর কত দূর। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের আগে অজ্ঞতা বেড়ে যাবে, ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, মানুষের হৃদয় কঠিন হয়ে যাবে এবং মারামারি, হত্যাযজ্ঞ বেড়ে যাবে।’ (সহিহ বুখারি)